
শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে দুই ছত্র
৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
১৯শে মে ২০১৮
৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ১৯শে মে ২০১৮
আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?
আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
লেখা জমা দিন১
শঙ্খ ঘোষের সাথে এক সকাল:
প্রতি রবিবার সকালে তিনি সর্বস্তরের লেখক-কবিদের আতিথ্য দেন। এমন নয় যে, অন্যদিন তিনি কাউকে দেখা দেন না। তবে রবিবারের সকালটায় তাঁর দুয়ার থাকে উন্মুক্ত। নিজেকেও সেই সকালটিতে লেখা বা পড়া থেকে ছুটি দেন তিনি। বসার ঘরটাতে চলে লেখক-কবি-লিটল ম্যাগ কর্মীদের অবিশ্রাম আসা-যাওয়া। কেউ কথা বলে তাঁর সাথে। কেউ কেউ নিজেদের মধ্যেও। সিঙারা, মিষ্টি আর চা আসতে থাকে অনর্গল। অতিথিরা খান আর কথা বলেন। তিনি সবসময়ের মতোই মুখে স্মিত হাসি নিয়ে বসে থাকেন। কথা বলেন কম। শোনেন বেশি। চিরাচরিত নিম্নকণ্ঠ।
২৯ এপ্রিল রবিবারই ছিল। গিয়েছিলাম আমরা তিনজন। কন্যা পপি বা সুকন্যা অধিকারী এবং রিংকু বৌদির সাথে আমি।
ঘরটা ছিল জমজমাট। সেৌমিত্র লাহিড়ী এবং কবি শ্রীজাত-এর কথা চলছিল। আমরা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কবির দৃষ্টি পড়ল পপির দিকে। কাছে ডেকে নিলেন তাকে। গল্প শুরু তার সাথে।
আমাকেও ডাকলেন পাশে। শ্রীজাত উঠে গিয়ে জায়গা করে দিলেন আমাকে। সঙ্গে নিয়েছিলাম উপন্যাস ‘১৯৯২’। তাঁর হাতে তুলে দিলাম। বইটা হাত নিয়ে হঠাৎ-ই তিনি ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। ৩/৪ মিনিট পরে বেরিয়ে এলেন হাতে ’মুসলমানমঙ্গল’ নিয়ে। বললেন– পয়লা বৈশাখে এই বইটা কিনেছি।
যে শঙ্খ ঘোষ পড়তে চাইলে লেখক-প্রকাশকরা তাদের র্যাক খালি করে বই দিয়ে আসেন, তিনি কিনেছেন ‘মুসলমানমঙ্গল’।
তারপরে আরেক বিস্ময়।
কথা বলে বেরিয়ে আসার সময় তিনি ঘরভর্তি অতিথি রেখে আমাদের বিদায় জানাতে দরজা পর্যন্ত। স্নেহস্পর্শে জড়িয়ে রেখেছিলেন আমার হাত। খুব প্রীতির সঙ্গে বললেন– লিখুন! লিখুন!
২
কোনোদিন তিনি বিপ্লবীর ভূমিকায় নেমেছেন বলে শুনিনি। অধ্যাপনা করেছেন, আর পড়েছেন, আর লিখেছেন। জীবনটা তাঁর লেখার জন্যই নিবেদিত। অন্যভাবে বলা যায়, লেখার জন্যই জন্ম নিয়েছেন তিনি। সেই লেখাকে প্রতিনিয়ত উন্নত করার সাধনায় মগ্ন থেকেছেন। তবে বাইরের জগত সম্পর্কে উদাসীন ছিলেন না মোটেও। এখনো নন। সমাজ-রাজনীতি তাঁর সাহিত্যে এসেছে প্রবলভাবে। তবে তা সাহিত্যের মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হয়েই। তাঁকে বামপন্থী বললে হয়তো তিনি আপত্তি করবেন না। তবে তার মানে এই নয় যে বামফ্রন্টের শাসনামলে তিনি তাদের সকল অন্যায় কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছেন। বরং প্রতিবাদ জানিয়েছেন কবিতায় এবং গদ্যে। কোনো পদ গ্রহণ করেননি। শিক্ষকতায় উঁচু পদে যাওয়ার জন্য কোনোদিন লবিং করেননি। নকশাল আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর কী ধারণা ছিল জানি না। তবে নকশাল আন্দোলনের সময় কোনো ছাত্র সেই আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য বিদায় চাইতে এলে তাকে নিরস্তও করেননি।
পথে নেমেছেন সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে দেবার বিজেপি-অপচেষ্টার বিরুদ্ধে। পথে নেমেছেন গণতন্ত্রের বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখলে। কর্মসূচি পালন শেষেই ফিরে গেছেন প্রিয় লেখার টেবিলে।
প্রতিভা নিয়ে অনেকেই জন্মায়। তবে সেই প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য সাধনা করতে হয় অধ্যবসায় এবং সততার সাথে। সততার কাঠগড়ায় বার বার বসিয়ে পরখ করে নিতে হয় নিজেকেই। তা তিনি করতে পেরেছেন বলেই হতে পেরেছেন বাঙালির বিবেকের বাতিঘর।
আমাদের এই বাংলাদেশে তাঁর মতো কেউ নেই। কারণ এখানে অনেক প্রতিভাবান লেখক-কবি-বুদ্ধিজীবী থাকলেও তারা নানা কারণে দল বা পৃষ্ঠপোষকের কথার বাইরে যেতে চান না। যান না কখনোই। হতে পারে দল বা সরকারের কিছু কাজকে তিনি পছন্দ করছেন না। কিন্তু সেটি বলতে গেলে যে সুবিধা হারাতে হবে, সেই হারানোর ভয়ে নিজের নিশ্চুপতার পক্ষে যুক্তি তৈরি করছেন।
আমাদের অধ্যাপক-বুদ্ধিজীবীদের মতো তিনি অবসর গ্রহণের আগে বা পরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যাননি। এনজিও-র উপদেষ্টা হননি। অর্থাৎ কারো পকেটে তিনি হাত ঢুকিয়ে রাখেননি। সেই কারণেই পকেট নড়লে তাকে নড়তে হয়নি।
ব্যক্তি শঙ্খ ঘোষ কথা বলেন খুবই নিচুকণ্ঠে। কবিতাতেও উচ্চকণ্ঠ নন। কিন্তু তাঁর কবিতা উচ্চকণ্ঠ করে তুলতে পারে পথহারানো মানুষকে। কদিন ধরেই তা আবারও শুনতে পাচ্ছি আমরা।