রবীন্দ্রনাথ কি আসলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন?

রবীন্দ্রনাথ কি আসলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করেছিলেন?

৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

১৮ই মে ২০১৮

৪ঠা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ১৮ই মে ২০১৮

আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?

আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখা জমা দিন
স্যার সলিমুল্লাহ্ ‘র সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংবর্ধনা সভায় রবীন্দ্রনাথ

কিছুদিন আগ পর্যন্তও জানতাম, রবীন্দ্রনাথ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিরোধী ছিলেন। কিন্তু বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ থেকে জানা গেল আসলে সে তথ্য ভুল। সেটা একটি অপপ্রচার, এবং এ অপপ্রচার ৩০ বছর ধরে চলছে। আদতে এই তথ্যের কোন Concrete প্রমাণ নেই। রবীন্দ্রনাথের মত কোন ব্যক্তি যখন কোন রাজনৈতিক ও সামাজিক ইস্যু নিয়ে বক্তব্য দেন অবশ্যই তার একটি Concrete প্রমাণ থাকার কথা।

তাছাড়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ছাড়া অন্যান্য যারা বিরোধিতা করেছিলেন তারাও বঙ্গ ভঙ্গের প্রতিবাদস্বরূপ এবং ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে করেছিলেন। কারণ, ব্রিটিশরা তখন হিন্দু-মুসলিম প্রশ্নে Divide & Rule নীতিতে চলছিল। তারাও ধর্মীয় জায়গা থেকে বিরোধিতা করেননি। তাছাড়া আরও কিছু ইস্যু ছিল। যেমনঃ পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের সমাজ চিন্তক, ধনী মুসলিম ও হিন্দুদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কিছু যুক্তি প্রদর্শন করেণ তাদের বিরোধিতার প্রশ্নে। এবং এদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই ছিলেন। এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পিছনেও যারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালণ করেছিলেন তাদের মধ্যেও হিন্দু-মুসলিম উভয় ধর্মের সমাজ চিন্তক ও প্রশাসনিক লোকজন ছিলেন। নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী, আবুল কাশেম ফজলুল হক, ঢাকার বলিয়াদির হিন্দু জমিদার এদের মধ্যে অন্যতম । জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর হিন্দু জমিদারবাবুর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে।

তবে পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিশিষ্ট মুসলমানগণ ও এর বিরোধিতা করেছিলেন। এদের মাঝে একজন মৌলানা আকরাম খান। তার যুক্তি ছিল, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। তাই বিশ্ববিদ্যালয় হলে পূর্ববঙ্গে নয়, পশ্চিম বঙ্গেই হতে হবে।

বিরোধিতাকারীর মধ্যে পূর্ব বঙ্গের বেশ কিছু মুসলমান ও ছিল। তাদের যুক্তি ছিল, মুসলিম সমাজে দশ হাজার জনের মধ্যে এক জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তেমন লাভ নেই, বরং এর পরিবর্তে স্কুল ও কলেজ নির্মাণ করা হোক। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, স্কুল-কলেজের জন্য আর বরাদ্দ পাওয়া যাবে না। সব অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ই পাবে বলে তাদের ধারণা ছিল।

আবদুর রসুল নামের আরেকজন বলেন, আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানদের পক্ষে ‘বিলাসিতা’। তার মতে কয়েকজন ভাগ্যবানের জন্য অর্থ ব্যয় না করে সর্বসাধারণের জন্য তা ব্যয় করা উচিৎ। চব্বিশ পরগণার জেলা মহামেডান এসোসিয়েশন ১৯১২-র ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যায় স্থাপনের বিরোধিতা করেছিল।

এছাড়া ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ এর সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এবং কয়েকটি গ্রন্থে দাবি করা হয় এই স্মারকলিপিতে রবীন্দ্রনাথ স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু আদতে এই স্মারকলিপিতে রবীন্দ্রনাথের কোন স্বাক্ষর দেবার প্রমাণ নেই।

এছাড়া অনেকে লিখিতভাবে প্রমাণ ছাড়াই বক্তব্য প্রকাশ করে স্রেফ বিদ্বেষ প্রসূত যে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে বিশাল জনসভা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে। এটাও একটি অকাট মিথ্যা। এরকম একটি সভা হলেও সেখানে তিনি উপস্থিত চ্ছিলেন না। কারণ সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। তাছাড়া, রবীন্দ্রনাথ ঠিক সেই সময় শিলাইদহে অবস্থান করছিলেন অসুস্থ অবস্থায়। ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে শিলাইদহে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন যা ঐসময়কার কবিতাগুলোর নিচে লেখা আছে (গীতিমাল্য গ্রন্থ, স্থির নয়নে তাকিয়ে আছি) এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার, ইংরেজি গীতাঞ্জলি লেখাও তখন শুরু করেন কবি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে রবীন্দ্রনাথ।তাঁদের ভালবাসা ও ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হয়েছিলেন তিনি

রবীন্দ্রনাথ ঢাকায় আসেন দু’বার। রবীন্দ্রনাথকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয় তিনবার, তাঁর মধ্যে দুবারই তিনি আমন্ত্রীত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৮৯৮ সালে প্রথম বার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবার ৫ বছর পরে, ১৯২৬ সালে তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকার জনগনের যৌথ আমন্ত্রণ পান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আতীথ্য গ্রহণ করেণ। সেখানে তিনি দীর্ঘ ভাষণ দেন। ১৯২৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী শুধু মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা তাঁকে সংবর্ধনা দেবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে এবং তিনি অতি আগ্রহে তা গ্রহণও করেণ। মুসলিম হলের শিক্ষার্থীদের আন্তরিক সংবর্ধনায় তিনি অভিভূত হয়ে বলেন:

“এই সভাগৃহে প্রবেশ করার পর থেকে এ পর্যন্ত আমার ওপর পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে। প্রাচীন শাস্ত্রে পড়েছি কৃতী ব্যক্তির উপর পুষ্পবৃষ্টি হয়। এ পুষ্পবৃষ্টি যদি তারই প্রমাণ করে তবে আমি আজ আনন্দিত।’ অভিভাষণের শেষে কবি বলেন, ‘ঈশ্বর এক, তাঁর মধ্যে কোনো ভেদ নাই। যিনি সকল বর্ণের, সকল জাতির জন্য নিত্য, তার গভীর প্রয়োজন প্রকাশ করছেন।‘’

এ সফরে এসে যেভাবে প্রথমে ঢাকার নবাবের আতিথ্যলাভ করেন এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংবর্ধিত হন, তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে বিরোধিতা করে থাকলে তা সম্ভব হতো না ।

তাছাড়া ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে ডিলিট উপাধি প্রদান করা হয়। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত হতে পারেননি। তাই তাঁর অনুপস্থিতিতেই তাঁকে এ উপাধি দেয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতাকারী হিসেবে এ উপাধি পাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব না।

যাইহোক, আমি রবীন্দ্র মৌলবাদী নই। কিন্ত এসব ঐতিহাসিক ব্যক্তি ও ঘটনা নিয়ে ভুল তথ্য ও মতাদর্শগত বিভ্রান্তি তৈরির তীব্র প্রতিবাদ জানাই। কারণ এ ধরণের তথ্য একটি বিপুল জনগোষ্ঠীকে শুধু বিভ্রান্তই করেনা, মিথ্যাবাদী ও অন্ধে পরিণত করে। এবং সে প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মিডিয়ায় সাম্প্রদায়িক লোকজনের অভাব নেই। একটি অনলাইন পত্রিকার এক সাম্প্রদায়িক সাংবাদিক এসব মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করলেই মিথ্যা Valid হয়ে যায় না।

স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সবচেয়ে দুর্বল জায়গা হল তারা বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে ভয়ানক পিছিয়ে। যেহেতু সৃজনশীলতার জায়গাটা ভয়ংকর ভাবে অনুর্বর তাই অন্য যেকোনো সর্বজন গ্রাহ্য Intellectual Figure তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। তাই তারা সার্বজনীন মহানায়কদের আগে নিজেদের মতই ধার্মিক/ধর্মবিরোধী/নির্দিষ্ট ধর্মবিরোধী বানাতে চায়। তারপর নানান মিথ্যা ও আধা মিথ্যা তথ্য দিয়ে অন্যদের বিভ্রান্ত করতে চায়। আত্মোন্নয়নের পরিবর্তে তারা অন্যদের ছোট বানিয়ে কিভাবে বড় হওয়া যায় সেই শর্টকাট খোঁজে। কিন্তু সত্য কোনদিন চাপা থাকে না। আর তাদের মূর্খতার জোরে তারা খুব সহজেই চিহ্নিত হতে থাকে।

রবীন্দ্রনাথের পূর্ববঙ্গের প্রতি দায়বদ্ধতা ও ভালবাসা খারিজ করতে মরিয়া সাম্প্রদায়িক একদল বোকার মত দাবি করে বসল যে রবীন্দ্রনাথ এ অঞ্চলের মানুষকে তুচ্ছ করত, তারা উদ্ধৃতি দিতে লাগল তারই ‘বঙ্গ মাতা’ কবিতার বিখ্যাত সেই দুই লাইনের। কিন্তু মনে হয় না তারা পুরো কবিতাটি কোনদিন চোখে দেখেছে বা পড়েছে। এবং কোন অনুভূতি থেকে কবি এমন একটি কবিতা লিখতে পারেন সেই বোঝাবুঝির ক্ষমতাও বোধ করি এদের নেই। এমন লোকের সংখ্যাই বেশি এ কবিতাটির ঐ দুটো লাইন এক শেখ মুজিবের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ভাষণ ছাড়া জীবনে আর কোথাও শোনেওনি, পড়েওনি। তাই এদের সাথে তর্ক করা মুশকিল। অথচ এরাই এই অপ্রচারে লিপ্ত এবং সবাইকে এই কবিতার রেফারেন্স টেনে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। সকলের জ্ঞাতার্থে পুরো কবিতাটি দিলাম:

“পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে

মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।

হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে

চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।

দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান

খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।

পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে

বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।

প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে

সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।

শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে

দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।

সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,

রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।”

রবীন্দ্রনাথের নিজের বাঙ্গালিত্বের ব্যাপারে যে সাজাত্যবোধ ছিল তা অসাধারণ। আত্মসমালোচনায় তিনি অন্য যেকোনো সাহিত্যিকের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। বাঙ্গালীর ঘরকুনো আর অলস স্বভাবের প্রতি বিরক্ত হয়ে লিখেছেন অনেক কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং গল্প। এবং সবটাই সামাজিকতা ও ভালবাসার দায়বদ্ধতা থেকে। এটা তারা বুঝবে না বিশেষত যাদের আত্মসমালোচনা ও আত্মোন্নয়নের অভ্যাস নেই, আকাঙ্ক্ষা ও নেই। যে সমাজে রবীন্দ্রনাথ আগে হিন্দু তারপর অন্যকিছু সে সমাজে উনার মানের সর্বজন গ্রাহ্য বুদ্ধিজীবী বা সমাজ সংস্কারক আদৌ তৈরি হবে কিনা সন্দেহ। তাই রবীন্দ্রনাথ যে খেদ করে বলেছিলেন, ” সাত কোটি বাঙ্গালীরে, হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙ্গালী করে, মানুষ করনি।” এটা আসলে আরও ন্যূনতম ৫০০ বছর ধরে সত্য থাকবে বলে ধরে নেয়া যায়।