দি গুড আর্থ রিভিউ

দি গুড আর্থ রিভিউ

১৪ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

২৮শে মে ২০১৮

১৪ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ২৮শে মে ২০১৮

আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?

আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখা জমা দিন

লেখকঃ পার্ল এস বাক্
অনুবাদঃ আব্দুল হাফিজ
প্রকাশনীঃ বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র

বিশ্বের সেরা ১০০ টি বইয়ের তালিকায় যে বইগুলোকে স্থান দেয়া হয়, তার মধ্যে অন্যতম নোবেল বিজয়ী পার্ল এস বাক্ এর ‘দি গুড আর্থ’ । ধারণা করা হয় , ১৮৯৬ তে ভার্জিনিয়ায় জন্ম নেয়া বাক এর চীনে কাটানো প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতা এই সাহিত্যকর্মটি রচনায় সুদূর প্রসারী ভূমিকা পালন করেছে ।

১৯৩১ এ প্রকাশিত বইটিতে লেখক মূলত তুলে এনেছেন বিপ্লবপূর্ব চীনের সামন্ততান্ত্রিক কৃষিনির্ভর জীবন আর কৃষিজীবী মানুষের চিরায়ত দুঃখ- কথা ,পাওয়া – না পাওয়ার আর্তিগাঁথা ।ব্যক্তির মাঝে সমগ্রকে , সমাজের মাঝে বিশ্বকে ধারণ করে দিয়েছেন স্বপ্ন- বাস্তবতার বিশ্বজনীন রূপ ।

১৯৩২ এ পুলিৎজার পুরস্কার জেতা বইটি প্রকাশের পর থেকেই মার্কিন মুল্লুকে ছিল বেস্ট সেলার । মনে করা হয়, ১৯৩৮ এ লেখকের নোবেল বিজয়ের ক্ষেত্রেও এ বইটির বিশেষ প্রভাব রয়েছে । শুধু মার্কিন মুল্লুক নয়, তৎকালিন চীনেও কৃষিজীবী প্রান্তিক মানুষের চিত্র এতটা নিখুঁত ভাবে আর কোন সাহিত্যকর্মে ফুটে উঠতে দেখা যায় নি বলে সাহিত্য বিশ্লেষকরা ধারনা করেন।
উপন্যাসের শুরু কেন্দ্রীয় চরিত্র ওয়াঙ লাঙ এর বিয়ের দিনের ঘটনা প্রবাহ দিয়ে। ওয়াঙ লাঙ একজন দরিদ্র চাষি। বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে তার দুই সদস্যদের পরিবার। এতই দরিদ্র তারা যে , প্রচন্ড কাশিতেও চা খাওয়া তাদের কাছে রূপো খাওয়ার মত বিলাসিতা । বৃদ্ধ বাবার দেখাশুনা, রান্না, জমিতে কাজ সব ওয়াঙ একাই করে। এই সংগ্রামী জীবনে স্ত্রীর আর্বিভাব কিভাবে তার জীবন বদলে দেবে ভেবে মন আন্দোলিত হয় তার। পরবর্তীতে স্ত্রী ওলানের আর্বিভাব প্রকৃত অর্থেই তার গোটাজীবনকে বদলে দেয়।

বিয়ের আয়োজন এবং এ সংক্রান্ত বর্ণনাতে লেখক তুলে এনেছেন দারিদ্রপিড়ীত মানুষের সাধ ও সাধ্যের চিরায়ত দ্বন্দ্ব , যাতে পাঠক মাত্রই পাঠের সাথে একাত্ত্ব হয়ে যাবে ।

ওয়াঙ এর স্ত্রী ওলান তাদের গ্রামেই এক জমিদার বাড়ির দাসী , যার বাবা- মা তাকে এই দুর্ভিক্ষের বছর অর্থের অভাবে জমিদারদের কাছে বিক্রি করে দেয় । কর্মদক্ষ এই মেয়েটি কুরূপা হওয়ায় জমিদারদের ভোগ-বিলাসের অযোগ্য । তাই, তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয় চাষী ওয়াঙ এর সাথে ।

এ অংশে দাস – দাসীদের জীবনের যে অমানবিক চিত্র উঠে আসে তা মনে করিয়ে দেয় স্টো’ এর ’আঙ্কল টমস কেবিন’ কে যদিও বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকে আছে ভিন্নতা ।

স্বল্পভাষী প্রভুভক্ত ওলান প্রচন্ড পরিশ্রমী। সংসার সামলে , মাঠেও কাজ করে স্বামী ওয়াঙ এর সাথে। দু’জনে শ্রমে ফসলও ফলতে থাকে দ্বিগুণ , আসে সমৃদ্ধি। শুধু ফসলের মাঠ না সংসারেও সমৃদ্ধি আনে সে একের পর এক পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে । সে সময় চীনে অধিক পুত্র সন্তান জন্ম দেয়াকে অধিক সমৃদ্ধির উপায় বলে মনে করা হত । কষ্টসহিষ্ণু ওলান এতটাই হিসেবি যে সন্তান জন্মের সময় একজন দাইও সাথে রাখে না সংসারের অর্থ সাশ্রয় হবে বলে। আবার সন্তান জন্মের সাথে সাথে চলে যায় মাঠে ফসল ফলাতে !

লেখক ওলানের জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারী জীবনের যে ধাপগুলো এঁকেছেন তা যে কোন পাঠকের অনুভূতিকেই নাড়া দিয়ে যাবে ।

দরিদ্র ওয়াঙ এর পরিবার যখন কিছুটা সমৃদ্ধির মুখ দেখছে, তখন গ্রামে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ক্ষুধার তাড়না মানুষকে কতটা অমানবিক আর বন্য করে তোলে তার হৃদয়বিদারক বর্ণনা আছে এ অংশে । আছে সুসময় – কঠিন সময়ে দেব-দেবতাদের প্রতি সাধারণের মনোভাবের স্বল্প কিন্তু সুগভীর বক্তব্য।

দুর্ভিক্ষের কারণে ওয়াঙ সপরিবারে চলে যায় দক্ষিণ দেশে । বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভাগ্যপিড়ীত সংগ্রামী নিগৃহীত জীবনের বাস্তবচিত্র লেখক তুলে ধরেছেন এই অংশে।

ঘটনা পরিক্রমায় একসময় ওয়াঙ এর পরিবার গ্রামে ফেরে । শুরু করে চাষবাস। আবারও ফেরে সমৃদ্ধি। উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আর বিত্ত-বৈভবের ঘেরা নতুন জীবনের সাথে সাথে এবার নতুন নারীরও আগমন ঘটে ওয়াঙ এর জীবনে ।

এতদিনে তার চোখে পড়ে ওলান সত্যিই শ্রীহীন।তার শ্রমনিষ্ঠায় সংসারে আসা সমৃদ্ধির জন্য তার প্রতি সহানুভুতি অনুভব করলেও , ভালোবাসা অনুভূত হয় না। যাতায়ত বাড়ে পানশালায়। পদ্মর রূপ আর প্রেমে আসক্তি হয় সে ।কিনে নেয় তাকে। গড়ে আলাদা বিলাসমহল।ফসলের উদ্বৃত্ত অর্থ গড়াতে থাকে ভোগ বিলাসে ।এক সময় উপলব্ধি করে মাটির সরল জীবন থেকে অনেকটা সরে এসেছে সে , নেই আগেকার শান্তি-স্বস্তি। নানান ঘাত- প্রতিঘাতে আগায় জীবন ।উপলব্ধি আর বাস্তবতায় ঠাসা জীবন তবু থেমে থাকে না । নিভু নিভু যৌবনে কলি নামক কণ্যাতুল্য আরেক নারীর আর্বিভাব ঘটে বার্ধক্য পিড়ীত ওয়াঙ এর জীবনে।

পুরো উপন্যাসে লেখক নারী-পুরুষ চরিত্রগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি ,মনস্তঃস্তত্ত্ব বেশ সুক্ষভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন বিশ্বজনীন বাস্তবতায় ।
তবে ঘটনার প্রবাহ , গতিময়তা সবকিছুই ঘিরে বারবার উঠে আসে কৃষি আর কৃষিকেন্দ্রীক ব্যক্তি ও সমাজ জীবন । মানুষের জীবন যে নিবিড় ভাবে মাটির সাথে যুক্ত এবং মাটিই যে আমাদের শেকড়,শেকড়ে সরল সুখ, বিচ্যুতিতে বিপত্তি-ব্যথা তা ই বারবার উঠে এসেছে ওয়াঙ লাঙ পরিবারের নানান ঘটনা প্রবাহে।

গল্পের ধাপে ধাপে যুক্ত আছে আরো অনেক চরিত্র,আছে ঘটনার নানামুখী প্রবাহ ,ওয়াঙ এর চাচা-চাচীর দৌড়াত্ন্য ,ওলানের তিন পুত্র-কণ্যার জীবন,তাদের বেড়ে ওঠা, বিবাহ পূর্ব এবং উত্তর নানা ক্রিয়া – প্রত্রিক্রিয়া। সর্বোপরি জীবনের বর্ধিত কলেবরের নানান ঘাত-প্রতিঘাত। এর মধ্যেও আসে বিপ্লব, আসে বদলে যাওয়া নতুন দেশ, আসে নতুন সমাজ বাস্তবতা ।

লেখকের সুক্ষ পর্যবেক্ষণে এসবই ফুটে উঠেছে কখনো সংক্ষেপে, কখনও সবিস্তারে । তবে বিপ্লব বিষয়ে আরো কিছু প্রসঙ্গের অবতারতা প্রত্যাশা জাগায় পাঠকহৃদে ।

প্রতিটি চরিত্রের সক্রিয়তা , কাহিনীর চমৎকার বুনট, মন ও মনঃস্তত্ত্বের নানান দিক এবং সর্বোপরি কৃষিকে ঘিরে ব্যক্তি- সমাজ জীবনের যে অসাধারণ চিত্র বাক এঁকেছেন তাতে পাঠকমাত্রই আলোড়িত হবেন।
বিশ্ব সাহিত্যের এ অনন্য সম্পদ সমৃদ্ধ করুক বিশ্বজোড়া পাঠকদের।