
বান্টির স্লো সাবান
২৮শে ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১২ই সেপ্টেম্বর ২০২৫
২৮শে ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ॥ ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২৫
৯৩৪ শব্দ · ⏱ পড়তে আনুমানিক ৫ মিনিট লাগবে
বান্টির সাবান নিয়ে যে কোনোদিন আমার ভাবতে বা লিখতে হবে তা আমি কোনোদিন ভাবিনি। আমি নিজে একজন সাবানমুক্ত মানবই বলা চলে। মানে পিছনে মা কিংবা বউয়ের প্রহরী চক্ষু না থাকলে আমি আদৌ তেমন সাবান দিয়ে হাত ক’বার ধুয়েছি জীবনে, তা হাতে গুণেই বলে দেয়া যাবে। উপরন্তু, ছোটোবেলাতে আমার জীবনে কোনো বউ ছিল না। ফলে প্রহরীও কম ছিল। সাবানও কম ছিল তখন। এরকম সাবানবিযুক্ত জীবনে বান্টির সাবান নিয়ে ভাবতে যে হলো তারও কারণ আছে। ওই যে বন্ধু! বান্টিরও তো বন্ধুর কারণেই এই দশা। মানে কিনা, যদি বান্টির বন্ধুরা তাকে বিপদে না ফেলত তাহলে তো আমরা বান্টির সম্বন্ধে জানতে পারতাম না। বন্ধুই সব!
তো আমারও কিছু বন্ধু আছেন। আসলে ফেসবুকেই আছেন। ভৌতজীবনে আমার বন্ধু শত্রু সবই কম বোধহয়। এমনকি নাই, মানে টের পাই না। আমি অলস মানুষ। কোথাও শারীরিকভাবে গিয়ে পালন করতে হবে এমন কিছুর মধ্যে কেবল চাকরিটাই করি। তাও বেতন না-দিলেও করব এমন বলে মনে হয় না। বেতনের লোভেই করি। আমার আলসেমির একটা রূপক হতে পারে তরমুজ। যে তরমুজ আমার অতি পছন্দ তা কিনতে গেলে সিঁড়ি ভাঙতে হবে বলেই পুরা মৌসুম আমি দান-খয়রাতের তরমুজের উপর ভরসা করে থাকি। বন্ধু তো আমার তরমুজের থেকে বেশি প্রিয় না, কিংবা আম। ফলে, রাজনীতি-সংস্কৃতি-ব্যাচ-জেলা কোনো ধরনের কোনো চক্রের চক্করে না-থাকা লোকের যেমন “বন্ধু” থাকে, বা না-থাকে, তেমনই আছে আমার। ফেসবুকের হিসেবই আলাদা। এখানে গাদাগাদা বন্ধু। এখানেই আমি কারো কবিতা পড়ি, কারো বিলাপ পড়ি। কারো ভালুকের মতো পোশাক পরে ইউরোপে ঘুরতে-থাকা দেখি। খুবই আ্মোদের ব্যাপার। এসব বন্ধু আমার খুবই প্রিয়।
তবে গত বছরগুলোতে দিনকে দিন এসব বন্ধুদের মধ্যে প্রবন্ধচর্চার তৎপরতা বেড়েছিল। সেসূত্রে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপদ্রবও বেড়েই যাচ্ছিল সাইবারে। তারপরও আত্মরক্ষা করে থাকা যায়। খোলাবাজারই তো। মেহফিল বা নামকীর্তনে বিছিয়ে রাখা হোগলার মতো। দরকার মতো শুনলেন, দরকার মতো একটু পিছন দিকে গিয়ে ঘুমিয়ে নিলেন। কেউ হাসিনা-ক্রিটিক, কেউ আওয়ামী ক্রিটিক, কেউ দেশজ জ্ঞানের বিস্তারের পক্ষে, কেউ আন্তর্জাতিক ফান্ডিংয়ের পক্ষে, কেউ র্যাংকিংয়ের পক্ষে, কেউ হাসিনার নিরীহ ভক্ত, কেউ হাসিনাকে দেখতে পারে না কিন্তু আওয়ামী লীগকে চায় – এভাবে প্রকৃতই বহুমাত্রিক এসব বন্ধু। আমার কোনোই সমস্যা হয় না এসবে। কিন্তু এরই মধ্যে জুলাই ২০২৪ আর তারপরে ০৫ আগস্ট চলে এলো। আমাদের নিকট অতীতে ঘটেনি এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। নানান রকমের নয়া নয়া এলায়েনমেন্ট নয়া নয়ার রাগ-ঘৃণা ছাড়াও নয়া নয়া প্রকাশ্য-গুপ্ত স্ট্র্যাটেজির মধ্যে আমরা পড়ে গেছিলাম। তো গেলাম, তাতেই বা আমার কী! মানে বান্টির কী! কিন্তু একটা হুড়াহুড়ি তো আছে। কে কবে থেকে কীভাবে ‘বিপ্লবী’ বা ‘এন্টি-ফ্যাসিস্ট’ তার একটা বিশদ ইতিহাস তথা জাদুঘর তথা প্রদর্শনীর আয়োজনও তো করতে পারার ব্যাপার আছে। ওই যে বান্টির বন্ধুদের হুড়াহুড়ি দেখেন না?
জাকারবার্গের বঙ্গবিজয়ের সাথে আওয়ামী লীগের অনন্ত আমলের একটা কাকতাল সম্পর্ক তো জানেনই। ফেসবুকের জনপ্রিয়তা আর আওয়ামী লীগের লাগাতার ক্ষমতায় থাকার কাল একই প্রায়। এর আগে তো আমাদের দৌড় ছিল কানকথা পর্যন্ত। এ ওকে গালাগালি রাগমন্দ করলে, যদি পত্রিকায় আসতো তাহলে জানতাম। ওদিকে রাজনৈতিক জ্ঞানচর্চাও চলত। প্রবন্ধ রচনার যার যা অভ্যাস ও বাতিক সবই ছিল পত্রিকার পাতায় পাতায়। আর মাঝেমধ্যে আমরা হাওয়াভবনে শিল্প-সংস্কৃতি-সাহিত্যচর্চার খবরগুলো শুনতাম। যেসব লোক দাবি করতেন সশরীরে হাওয়াভবনে গেছেন, তাঁদের দিকে আমাদের তাকিয়ে-থাকাও একটা দেখার মতো ব্যাপার হতো। মুগ্ধতায় আমাদের চোখের মণি গলে বের হয়ে আসতো। আহা, এই লোক তো ক্ষণজন্মা পুরুষ! জাকারবার্গের ময়দানে এসে অনেক কিছুই লেভেলপ্লেইং ফিল্ড বানিয়ে ছাড়লো। সবাইকেই প্রায় (সবাইকে না আসলে) দেখা যাচ্ছে। খাচ্ছে, হাই তুলছে, গাইলাচ্ছে, জ্ঞানগর্ভ রচনা লিখছে। কী যে একটা ব্যাপারস্যাপার! সেইইইরকম! এখানে হুড়াহুড়ির ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তো এর মধ্যে কিছু বন্ধুবান্ধব নিজ নিজ পক্ষের বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসেছেন ফেসবুকে। এখানে রীতিমতো ক্লাস হয়। স্কুলই বলতে পারতাম। কিন্তু বাংলাদেশে এখনও স্কুল শব্দটা ওই সখিপুর বালিকা বিদ্যালয়, লক্ষণগাছা প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ভিজ্যুয়াল/ইমেজারি হাজির করে। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় বললাম। ভার্সিটিও বলা যেতো। এঁরা খালি ক্লাস নেন। নিতেই থাকেন। সকল কিছু সম্ভাব্য অনুসারীদের পঁইপঁই করে পড়ান ফেসবুকে। ভেঙে ভেঙে, একদম শাঁস বের করে করে। কী যে আন্তরিক সেগুলো! কিন্তু হলে কী হবে! ওই যে নিজ নিজ পক্ষ। সকলেই নিজ নিজ ফিল্টার দিয়ে নিজ নিজ উচ্ছ্বাস দিয়ে পড়েন। কিংবা নিজ নিজ প্রতিপক্ষতা দিয়ে ঘৃণা ছিটিয়ে যান। আমার মোটের উপর এগুলো বাক্য-উপদ্রুত বাতিক বলেই মনে হয়। একদম কিছু বিরল ইনসাইট ছাড়া। যাকগে, আমি প্রসঙ্গ নই।
তো, লোকজন এত দিনের বিদ্যাচর্চা, এতসব প্রস্তুতি, এতসব প্রদর্শনীর আইটেম। সময় তো একটু লাগবেই। যতই হুড়াহুড়ি চলুক, সময় তো একটু লাগবেই। ফলে ধারাবাহিক সব ডিম্বপ্রকাশ চলছেই। বান্টি তো হাত ধুতেই আছে ধুতেই আছে। সাবানও খুবই একটা রহস্যজনক বস্তু। সাবানকে যত নিরীহ ভাবছেন ততটা নয়। এটা নিয়ে গোপনীয়তা নেই ভাবছেন? ওই যে বান্টির কথা! বুঝলাম যে বান্টি হাত ধুচ্ছে। কিন্তু কেউ কি অস্বীকার করবেন যে মধ্যবিত্ত পিতামাতারা সাবান ব্যবহার শেখানোর জন্য কিছুতেই খাবারের-আগে-হাত-ধৌতকরণকে প্রথম নিমিত্ত হিসেবে ব্যবহার করেননি? করবেন অস্বীকার যে অন্য একটা কর্মকাণ্ডের সমাপনী ক্রিয়া হিসেবে প্রথম সাবানের ব্যবহার শেখানো হয়নি? কিন্তু দেখুন! বান্টির বন্ধুরা তো বটেই, বিজ্ঞাপন সংস্থার লোকজনও সাবানের সেই জীবনটাকে গোপনীয় রেখে দিয়েছে।
বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো যে কেবল সাবানের এই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটি গোপন রেখেছে তাই-ই কেবল নয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর লড়াই একটা বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটাও প্রায় গোপনই আছে। জাতিসংঘের সচেতনী কর্মকাণ্ডগুলোও বিজ্ঞাপনই। এবং বছরে বছরে খরচের পরিমাণটা বেশ বড়ই। যাহোক, ওই আলাপ করতে বসলে আমাদের নায়ক/বৃন্দ বান্টি গৌণ হয়ে যেতে পারে।
যাহোক, একটা দার্শনিক বিপর্যয়কে চিহ্নিত করতেই আজকের এই বান্টি বিষয়ক রচনা। দেখুন, বান্টি যে হাত ধুতেই আছে সেটার প্রকৃত কারণ কিন্তু অতটা সরল বোধগম্য নয়। কিছুতেই আর বোঝা যায় না যে বান্টি যে হাত ধুতেই আছে সেটা কি খাদ্যগ্রহণের প্রারম্ভিক কালে? নাকি অন্য কোনো কর্মকাণ্ডের সমাপনী কালে? বান্টি কিন্তু হাত ধুতেই আছে। আমার ফেসবুক বন্ধুরা একটা সিলাবাস বানিয়েছিলেন, আন্দাজ করি। ওদিকে ঘটনা ঘটছে অতিশয় দ্রুত। তাঁরাও তাঁদের নিজনিজ প্রণীত সিলাবাস না শেষ করা পর্যন্ত হয়তো শান্তি পাচ্ছেন না। ফলে ফেসবুক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তাঁদের রচনাগুলোও চলতেই আছে।
বান্টির স্লো সাবানের নিমিত্ত যাই হোক, পুরা সাবান শেষ না হওয়া পর্যন্ত বোধহয় আমাদের খেতেই হবে। ওরে গবা! নিয়তের লড়াইয়ে জ্ঞানের আলাপ করিস নে!! অন্তত যাঁরা করবেনই তাঁদের সাবান শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর না বাপু!