আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?
আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
লেখা জমা দিনআমি জানি না ওই দুই শব্দে কী আছে, কিন্তু যখন জোরে জোরে আওড়াই, সেই আওয়াজ বড়ো সঠিক সুরে বাজে। মনে হয় এ এমন কিছু যা আমরা প্রত্যেকে নিজেদের জীবনে আকুল ভাবে চাই, এমন কিছু যা আমাদের ভীষণ প্রয়োজন। আমরা একটা বৃহৎ কিছুর অংশ হতে চাই, কিন্তু বাস্তবত সে চাওয়া মেকি উপায়ে, দেনাপাওনার হিসেবে, অথবা নিজের সঙ্গে আপোস ক’রে, মেলে না। আমাদের সত্যিকারের নাড়ীর যোগ জরুরি – কিন্তু এর অর্থ কী?
২০১০ সালে আমি ‘গিফটস অভ ইম্পারফেকশন’ (ভগ্নতার উপহার) বইতে আপন হওয়ার এক সংজ্ঞা দিয়েছিলাম এই ভাবে,
“আপন হওয়া — আমাদের থেকে আরো বড়ো কিছুর সঙ্গে আমাদের যোগের সহজাত আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা এমন আদ্যিকালের যে আমরা খাপে খাপে মিলে অথবা অপরের অনুমোদন নিয়ে তা মেটানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সে তো আপন হওয়ার ফাঁপা চেষ্টাই শুধু নয়, বরং আপন হওয়ার পথে পর্বতপ্রমাণ বাধা। কারণ আমাদের মধ্যে হাজার গোলমাল নিয়েই এই স্বকীয় সত্তাকে যখন সাহসের সঙ্গে জগতের কাছে তুলে ধরতে পারি, তখনই আমরা নিজেদের আপন হই, অথবা বলা যায় নিজেদের মনের মানুষ হই। আমাদের আপন হওয়ার বোধ কখনো আমাদের আত্ম-অনুমোদনকে ছাপিয়ে যেতে পারে না।”
এই সংজ্ঞা নতুন উপাত্তের জেরেও টিকে আছে। তবু সে সম্পূর্ণ নয়। আরো কিছু বলা বাকি থাকে। আপন হতে হলে অনেক সময় একা দাঁড়াতে হয়, নির্ভেজাল, নিরালম্ব একা। যখন আমি ওপরের ওই সংজ্ঞা লিখেছি, আমি ভেবেছি আপন হওয়া কোনো বাইরের ঘটনা। বাস্তবে নিজেদের না লুকিয়ে, ঋজু দাঁড়ালে যা পাওয়া যায়, যদিও তারপর বাইরের লোকের কোনো অভিজ্ঞতার আনুকুল্য আমাদের দরকার হয়। কিন্তু যত গভীরে যাই, তত টের পেতে থাকি, এ তো অন্যের স্বীকৃতিতে পড়ে পাওয়া বাইরের সফলতা নয়, এ এমন জিনিস যা আমরা হৃদয়ে বয়ে বেড়াই। আমরা যখন নিজেদের ওপর সেই অসীম আস্থা রাখি, নিজের মনের মানুষ হই নিজে, তখনই আপন হওয়ার মহাব্রতে আমরা সফল।
আপন মনের মানুষ হওয়া মানে সম্পূর্ণ একা দাঁড়ানোর ডাক। যে জনঅরণ্যে আছে অনিশ্চয়তা, ব্যথা পাবার অশেষ সম্ভাবনা, আর সমালোচনা — সেই ক্ষেত্রকে রাজনৈতিক এবং আদর্শের যুদ্ধক্ষেত্র মনে না করে উপায় নেই। তাই সেই যুদ্ধক্ষেত্রে একা দাঁড়ানো বড়ো কঠিন। আমরা যা ভুলে গেছি তা হল, আমরা যখন ভীষণ একা, তখনো আমরা একে অপরের সঙ্গে বাঁধা। সে বাঁধন দলের খাতায় নাম লিখিয়ে হয়নি, রাজনৈতিক মতের মিলে হয়নি, আদর্শের কারণেও হয়নি। আমাদের বাঁধনের সুতো আমাদের ভালোবাসা, আমাদের মানব আত্মা। আমরা নিজেদের যত বিচ্ছিন্ন মনে করি না কেন, আমরা সেই এক মানবগাথার অংশ।
আপন হওয়া বলে কাকে ?
আমি একজন উৎকর্ষ-তাত্ত্বিক মাটি-ভিত্তিক সমাজবিজ্ঞানী। মাটি-ভিত্তিক বলতে আমার গবেষণার উপাত্ত আসে মানুষের সত্যিকার অভিজ্ঞতা থেকে। আমি কোনও তত্ত্বকে সত্যি বা ভুল প্রমাণ করি না। মাটিভিত্তিক গবেষণায় গবেষক চান অংশগ্রহণকারীদের “মূল ভাবনা”-কে চিহ্নিত করতে। তাই আপন হওয়া কাকে বলে জানতে গিয়ে আমার প্রশ্ন ছিল, মানুষ আসলে কী পেতে চেষ্টা করে? কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করে তারা?
এর উত্তর অভাবনীয় রকম জটিল। তারা একটা কিছুর অংশ হওয়ার চেষ্টা করে বটে — অন্যের সঙ্গে তারা সত্যিকারের বাঁধন অনুভব করতে চায় – কিন্তু স্বকীয়তা, স্বাধীনতা আর ক্ষমতার অধিকার ছেড়ে দিয়ে নয়। এছাড়া অংশগ্রহণকারীরা জানান, তাদের ঘিরে থাকা এক “আমরা বনাম তারা” সংস্কৃতি আত্মিক বিচ্ছিন্নতার দিকে ঠেলে দেয় তাদের। আত্মিক বিচ্ছিন্নতা বলতে কী বোঝায় তার গভীরে হানা দিয়ে আমি জানতে পারি, তারা একই মানবতা বোধে যুক্ত থাকার যে অনুভূতি, তা ক্রমশ কমে আসছে — এ কথা বোঝাতে চায়। অংশগ্রহণকারীরা আমাকে বারবার বলে, আমাদের যা যুক্ত করে তা মানবতা, আস্থা, শ্রদ্ধা বা ভালোবাসা নয়, বরং আমাদের যা যুক্ত করে তা ঘৃণা আর ভয়। তারা বলে, তাদের বন্ধু, সহকর্মী আর পরিবারের সঙ্গে একমত না হবার সাহস তারা পায় না — কারণ সামাজিক সহবত আর সহনশক্তির একান্ত অভাব তারা লক্ষ করে।
দলের আনুগত্য আর নিজের কাছে আনুগত্য – এই দুইয়ের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে তারা চায় না, অথচ মানবতা বোধ থেকে আত্মিক বিচ্ছিন্নতা তাদের চাপ দেয় সমাজের খাপে হুবহু মিলে যাবার জন্য। এক বৃহত্তর মানব পরিবারের সঙ্গে সংযোগ মানুষকে তার স্বাতন্ত্র্য মেলে ধরার স্বাধীনতা দেয়, এবং তা দেয় আপন হওয়ার বোধকে না খরচ করে। এমনতর যেন আর হয় না, যখন আমরা বলতে পারি, “হ্যাঁ, আমরা নিশ্চয়ই নানান ভাবে স্বতন্ত্র, কিন্তু কোনো এক গহন জায়গায় আমরা গভীর ভাবে যুক্ত।”
আপন হবার মূল ভাবনাগুলিকে বুঝতে চেয়ে আমার ‘ভগ্নতার উপহার’ বইটি লেখার সময়কার ২০১০ সালের উপাত্তের কাছে ফিরে আসি আমি,
“আধ্যাত্মিকতা মানে হল, আমাদের সকলের থেকে একটি বৃহত্তর শক্তির বাঁধনে আমরা যে সকলে অঙ্গাঙ্গিভাবে বাঁধা এবং সেই বাঁধন ভালবাসা আর সহমর্মিতা থেকে জন্মায়, সেটি জানা, এবং তা সমারোহে উদযাপন করা”
“অঙ্গাঙ্গিভাবে বাঁধা” কথাটা আমি পড়তে থাকি বারবার। সেই গ্রন্থি আমরা ভেঙে ফেলেছি। পরের অধ্যায়ে কী ভাবে আমরা সে গ্রন্থি ভেঙেছি, কেন ভেঙেছি, তা দেখব। বইয়ের বাকি অংশ হবে কী করে সেই গ্রন্থি আমরা ফের রচনা করতে পারি, তাই নিয়ে।
(চলবে…)
প্রখ্যাত লেখক, গবেষক ও হিউস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ব্রেনে ব্রাউনের জনপ্রিয় ভাষণ এবং মানুষের বিভিন্ন আন্তঃ ব্যাক্তিগত
বিষয় নিয়ে ভাবনাকে ব্যাখ্যা ও অনুবাদ করেছেন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ও অনুবাদক আনন্দময়ী মজুমদার
(চলবে…)