ব্রেনে ব্রাউন কি প্রাসঙ্গিক? – ৩

ব্রেনে ব্রাউন কি প্রাসঙ্গিক? – ৩

১০ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

২৪শে মে ২০১৮

১০ই জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ২৪শে মে ২০১৮

আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?

আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখা জমা দিন

ব্রেনে ব্রাউন পড়ি আর বুঝতে শুরু করি তিনি এমন কিছু লিখেছেন যা একেবারে প্রত্যেক মানুষের জন্য,কেউ বাদ যাবে না। ব্যথা নিয়ে কথা বলছিলেন তিনি। যে বেদনাকে অস্বীকার করতে চেয়ে আমরা ঘৃণার আড়ালে মুখ লুকিয়ে রাখি।

ব্রেনে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎকারের উপাত্ত ঘেঁটে দেখছেন, বেদনা থাকে না,যখন একে সম্পূর্ণ স্বীকার করে বরণ করে নেওয়া হয়,এবং সেবাযত্ন দেওয়া হয়। ব্যথাকে মমতার সঙ্গে স্বীকার করে নেওয়া খুব একটা কঠিন নয়,এর জন্য এমন কিছু শক্তিও লাগে না। তার চেয়ে ঢের বেশি শক্তি খরচ হয় তাকে অস্বীকার করতে গিয়ে।

কিন্তু সমস্যা হল,আমাদের মধ্যে প্রায় কেউই বেদনাকে চিনতে শিখিনি। আমাদের পরিবার আর সমাজ আমাদের শিখিয়ে এসেছে বেদনাকে স্বীকার করা মানে হল দুর্বলতা। তারা শিখিয়ে এসেছে,লোকজনের পরিহাস অথবা পরিত্যাগের মুখে নিজেকে আড়াল না করে স্বচ্ছতা আর সাহস নিয়ে নিজের মতো দাঁড়ানো এক ধরনের দুর্বলতা। সেই জন্য পরিবার এবং সমাজ আমাদের শেখায় ক্রোধ, অন্ধ ক্রোধ, আর অস্বীকারবোধ।

কিন্তু ব্রেনে আর তাঁর গবেষক যা জানেন,তা হল,আমরা যখন আমাদের আবেগ-অনুভূতিকে অস্বীকার করি, তখন ভুতের মতো তারা আমাদের পেয়ে বসে,আমাদের হয়তো বা অজান্তেই। যখন তাদের স্বীকার করে ধারণ আর বরণ করে নিই, কেবল তখন বেদনার ভিতর দিয়ে পথ খুঁজে, নতুন জীবন গড়ে বেরিয়ে আসতে পারি।

কখনো কখনো নিজের আবেগ-অনুভূতিকে মানলে, সংগ্রামের দিকে তাকালে, আমাদের বেশ রাগ হয়। রাগ অনুভব করার স্বাধীনতা আমাদের যদি না থাকে তবে বেদনাকেও অস্বীকার করতে হয়। আমাদের সমাজে আমরা শুনি,‘এত রাগ কেন?’, ‘এটা ব্যক্তিগত বিষয় না’,‘মাথা গরম করো না’ ইত্যাদি। এ ধরনের প্রতিক্রিয়ার ভিতরে একটা বীজকথা আছে,সেটা হল – ‘তোমার আবেগ, মতামত আমাকে অস্বস্তি দিচ্ছে। চুপ করে থাকো।’

এর আর একটা সম্ভাব্য উত্তর হল: ‘রাগ করে যাও, করতেই থাকো।’ কিন্তু গবেষণায় সে ধরনের উত্তর আমরা খুঁজে পাচ্ছি না। ব্রেনে দেখছেন, ক্রোধ যেহেতু একটা জরুরি মানুষী অভিজ্ঞতা, একে অনুভব করা আমাদের অধিকার। সেই সঙ্গে এই ব্যাপারেও সচেতন থাকা জরুরি যে ক্রোধ, অন্ধ ক্রোধ, আক্রোশ (খানিকটা ক্রোধ আর খানিকটা ধিক্কারের মিশেল) অনেক অনেক দিন ধরে জিইয়ে রাখা সম্ভব না। ক্রোধ একটি ক্যাটালিস্ট বা অনুঘটক। এই ক্রোধের মধ্যে জীবনযাপন করলে আমাদের ক্লান্ত, অসুস্থ লাগে। একে সারাক্ষণ জিইয়ে রাখলে আমরা আমাদের আনন্দ আর উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। আবার একে বাদ দিয়ে চলতে চাইলে আমরা মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারিয়ে ফেলতে পারি। মানুষের সঙ্গে সংযোগ হারালে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব না। সুতরাং একে মেনে নিয়ে এবং একে রূপান্তরিত করে,আকার বদলে এমন কিছু তৈরি করতে হবে যা কুলকুল জীবন এনে দেয় বুকের কাছে – যেমন, সাহস, ভালোবাসা, সুন্দর পরিবর্তন, করুণা, ন্যায়।

কখনো কখনো রাগ আমাদের ভিতরকার আসল আবেগকে ঢেকে রাখে, যেমন শোক, অনুশোচনা, লজ্জা – আর তখন আমাদের হৃদয় খুঁড়ে সেই অনুভূতিকে চিনতে হয়।

অর্থাৎ কিনা ক্রোধ এক দারুণ অনুঘটক, কিন্তু আটপৌরে সঙ্গী হিসেবে তা জীবনের সব রসকে শুষে নেয়।

এই প্রসঙ্গে একটা লাইন মনে পড়ল, ‘তুমি আমার ঘৃণা পাবে না’। ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে অঁতোয়ান লেরি একথা বলেছিলেন। তাঁর  স্ত্রী ইলেন প্যারিসের ব্যাটাক্লান থিয়েটারে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন – আরো ৮৮ নিহত মানুষ ছিলেন সেই দলে।

বেদনাকে অস্বীকার করলে তা রূপান্তরিত হয় ভয় আর ঘৃণায়। যে ক্রোধ রূপান্তরিত হয় না,তা হয়ে ওঠে অসন্তোষ আর তিক্ততা।

২০১৫ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কৈলাস বিদ্যার্থী তাঁর টেড টকে বলেছিলেন,
“সকলের মধ্যে ক্রোধ আছে, আর আমি কিছু সেকেন্ডের জন্য একটা গোপন কথা ভাগ করে নিতে চাই –  আমরা যদি আমাদের ইগো,অহংবোধ,স্বার্থপরতার দেয়াল তুলে ক্রোধকে নিজেদের মধ্যে বেঁধে রাখি,তাহলে তা তৈরি করবে ঘৃণা,সন্ত্রাস, প্রতিহিংসা,ধ্বংস। কিন্তু আমাদের মধ্যেকার অহংকারের দেয়াল যদি আমাদের মানবিক করুণা আর ভালোবাসার স্বাভাবিক শক্তি খাটিয়ে ভেঙে ফেলি তাহলে পৃথিবী আরেকটু বাসযোগ্য হবে, সুন্দর হবে। সেই একই ক্রোধ এই সুন্দর দুনিয়া বানাতে পারে, দেয়াল ভেঙে ফেললে তবেই।”

আক্রোশের মূল্য আমরা জীবন মেপে দিই, আর সেটা খুব চড়া মূল্য সন্দেহ নেই।

 সূত্র