আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?
আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
লেখা জমা দিনবাস্তব উপাত্ত আমাকে বুঝিয়ে দেয়, আপন হওয়া কাকে বলে আর কী ভাবে আপন হতে হয় এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে আজকের দুনিয়ার মতাদর্শের তীব্র ভেদাভেদের বাস্তব ছবি এড়িয়ে, রাজনৈতিক আদর্শের ঝগড়া বিবাদ এড়িয়ে আমরা তা পারব না। অথচ দেখুন আমি এসবের মধ্যে আদৌ যেতে চাইনি। কিন্তু আমি তো আমার উপাত্তকে অস্বীকার করতে পারি না। উপাত্ত আমাকে যেখানে নিয়ে যায়, আমি সেখানেই যেতে বাধ্য।
আমার গবেষণায় খুঁজে পাওয়া চারখানা সারকথা নিচে দিলাম। একটু দেখলে বোঝা যাবে সব কটাই আসলে প্রাত্যহিক চর্চার বিষয়। আবার কেমন যেন সেসব ধাঁধার মতো মনে হয়। অর্থাৎ চারটেই আমাদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় —
১) কাছ থেকে মানুষকে ঘৃণা করা কঠিন। কাছে যান।
২) বকোয়াজ কথাকে সত্য দিয়ে প্রতিহত করুন। শালীনতা বজায় রেখে।
৩) হাত বাড়িয়ে দিন। অপরিচিত মানুষের দিকে।
৪) দৃঢ় পিঠ। কোমল বুক। বন্য হৃদয়।
“অরণ্য”
উপাত্ত থেকে আপন হবার ব্যাপারে যতটা স্বচ্ছ ছবি পাওয়া যায় সেখান থেকে বুঝি আপন হতে গেলে মাঝেমাঝে ঝড়তুফানের মধ্যে একা দাঁড়িয়ে যেতে হবে, যতই সমালোচনা আর পরিত্যক্ত হবার ভয় থাকুক। এই চিত্র দেখে আমার অরণ্যের কথা মনে হয়। ধর্ম, সাহিত্য, কবিতা, শিল্পে আমরা অরণ্যের উপমা পাই। কখনো সেই উপমা এক অদ্ভুত বিপদসংকুল ক্ষেত্র যেখানে আমরা নানা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পথ খুঁজে ফিরি। আবার কখনো সে এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা জায়গা যেখানে আমরা গভীর কোনো উপলব্ধি আবিষ্কার করি। এই উপমার মধ্যে যা বারবার চলে আসে, তা হল একাকীত্ব, ব্যথা পাবার সম্ভাবনা এবং অনুভুতির, শারীরিক বা আত্মিক উত্তরণের তালাশ।
নিজের কাছে এতোটা আপন হয়েছি যে নিজে বিলকুল একা দাঁড়াতে পারি এই অবস্থা নিশ্চয়ই এক অরণ্যের সঙ্গে তুলনীয়। এ অরণ্য অনিশ্চয়তায় ভরা। এখানে একাকী দাঁড়াতে হয়। তালাশ চালাতে হয়। এ জায়গা যেমন বিপদসঙ্কুল তেমনি অসাধারণ সুন্দর। একে যেমন ভয় করে, আবার এর তালাশ করে মানুষ। এই অরণ্যকে অনিষ্টকারী মনে হতে পারে, কারণ এ আমাদের নিয়ন্ত্রণের অধীন নয়, যেমন নিয়ন্ত্রণের অধীন নয় এই বিশাল প্রান্তরে আমাদের অনুপ্রবেশের পথ কেমন হবে সে নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্তকে কে কেমন ভাবে মূল্যায়ন করছে তা। কিন্তু এই সেই আপন হবার ক্ষেত্র, সব চেয়ে সাহসী আর সব চেয়ে পবিত্র জায়গা আমাদের।
আপন হবার জন্য আমাদের যে সাহস প্রয়োজন, তা শুধু অরণ্যে সাহসী পদক্ষেপ ফেলার জন্যই নয়, বরং খোদ সেই অরণ্য হয়ে ওঠার জন্য। সে সাহস দরকার আমাদের মধ্যেকার দেয়াল ভেঙে ফেলা, মতাদর্শের খুপরি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য, এবং দামাল এক বন্য হৃদয় নিয়ে বাঁচার জন্য, ক্লান্ত জখম নিয়ে নয়।
এই দুর্গম জঙ্গলে তো তৈরি রাজপথ মেলে না। যতই অন্য মানুষের এই বনের ভিতর চলার অভিজ্ঞতাকে উপাত্তের ভিতর দিয়ে সংগ্রহ করে নিই না কেন, এর গহনে প্রবেশ করার পথ নিজেকে চিনতে হবে। আমার মতো যদি কেউ হয়, তবে তার কিছু অংশ পছন্দ হবে না।
আমাদের স্বেচ্ছায় এমন মানুষের সঙ্গে এখানে সময় কাটাতে হবে যারা আমাদের মতন নয়। আমাদের সর্বজনীন টেবিলে বসার জন্য তৎপর হতে হবে। আমাদের জানতে হবে কী ভাবে মন দিয়ে শুনতে হয়, কী ভাবে কঠিন বাক্যালাপ চালাতে হয়, কী ভাবে আনন্দের তালাশ করতে হয়, কী ভাবে বেদনা ভাগ করে নিতে হয়, সুরুক্ষার চেয়ে কৌতূহলের দিকে ঝুঁকতে হয় বেশি, প্রতি মুহূর্ত একাত্মতা খুঁজতে গিয়ে।
সত্যিকারের আপন হবার রাস্তা নিষ্ক্রিয় নয়। একটি দলে নাম লেখানো নয়। খাপে খাপে মিলে যাওয়া নয়। ভান করা নয়। নিরাপত্তা চাই ব’লেই রফা করা নয়। এ এমন অনুশীলন যেখানে আমরা ব্যথা পেতে পারি, যেখানে আমাদের অস্বস্তি হয়, নিজেদের স্বভাব আর পরিচয়কে না বিকিয়ে যেখানে আমরা মানুষের কাছে হাজির হতে পারি। আমরা আপন হতেই চাই, কিন্তু জেনেশুনে কঠিন মুহূর্তকে ডেকে আনার জন্য অসম সাহসের প্রয়োজন।
অনুবাদঃ আনন্দময়ী মজুমদার