জ্ঞানবানের ভক্তি আর আনুগত্য

জ্ঞানবানের ভক্তি আর আনুগত্য

১৩ই আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

২৭শে জুন ২০২৫

১৩ই আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ॥ ২৭শে জুন ২০২৫

৮১০ শব্দ · ⏱ পড়তে আনুমানিক মিনিট লাগবে

অনেক বছর আগের কথা। হয়তো ১৯৯৩ আমি তখন বেকার। আর বেকুব। বেকুব কারণ তখনও আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি পাবার ইচ্ছায় বসে আছি। বেকুব কারণ আমার তখনই বোঝা উচিত ছিল আমার মতো গরিবি পটভূমির লোকের একটা ভাল বেতনের চাকরি খোঁজাই উত্তম ছিল। চাকরি কীভাবে খুঁজতে হয় তাও খুব ভাল বুঝতাম না। শুক্রবারের ইত্তেফাক দেখে দেখে পোস্ট অফিসে গিয়ে চাকরির আবেদনপত্র পাঠাই কেবল। লোকজনের সাথে দেখা করে চাকরি পেতে হয় – এই কথা দুচারজন বলেছিল আমাকে। কিন্তু কোন কোন লোকজনের সাথে কোথায় কোথায় গিয়ে কীভাবে কীভাবে দেখা করে কী কী বলতে হয় এসব খুব একটা মাথায় আসতো না। এর মধ্যে আমার সাবলেটের থাকার জায়গায় হলো এক ভেজাল। এখানে ঘুমাই, ওখানে ঘুমাই।

তো এর মধ্যে বিভিন্ন বিভাগের সহপাঠি যাঁরা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন তাঁদের কেউ কেউ আমার চাকরি না-হওয়া নিয়ে একটু অস্বস্তিও বোধ করেন। কেউ কেউ হয়তো বেদনাও বোধ করেন। এদের একজন আমাকে অনুরোধ করল যেন আমি একটা দিন অন্তত তার কথামতো চলি। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি সেটাতে রাজি হলাম। তার স্ক্রিপ্ট খুব সহজও ছিল। তেমন কোনো হাত কচলানির দায়িত্ব ছিল না আমার।

স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী ও তার বিভাগের রয়্যাল বেঙ্গল অধ্যাপকের ঘরে ঢুকলো। সহপাঠি বন্ধুটি হুইল চেয়ারে চলত। অর্থনীতি বিভাগের সেই মহাক্ষমতাধর অধ্যাপকের ঘরে ঢুকল সে। আমি একটু দূরে ছিলাম। ঢুকবার কিছু পর আমি বন্ধুটির খোঁজে সেই অধ্যাপকের ঘরে গেছি। এরকমই ছিল স্ক্রিপ্টে। ছোটো বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্লি ৯০-এ এগুলো বড় কোনো সমস্যা ছিল না। অন্তত আমি আরেক বিভাগের বড় অধ্যাপকের ঘরে কাউকে খুঁজতে যেতে পারি ধরনের একটা লোক ছিলাম। আমার বন্ধু আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। জানালেন সেই অধ্যাপকও ‘কী মানস, কেমন আছো?’ বন্ধুটি ওর স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করল: ‘মানসের চাকরিটা হচ্ছে না কেন স্যার, আপনারা থাকতে?’ দয়ালু বন্ধুটির হিসাব খুব সহজ ছিল। জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে আমার বদনাম যাই থাকুক, “তীক্ষ্ণ ছাত্রের” সুনামটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। ফলে সে ভেবেছিল, এতে নানান-ঘটন-পটিয়সী সেই অধ্যাপকের উপর চাপ পড়বে। অধ্যাপক কিছুটা সময় নিলেন। তাতে মনে হয় চাপের হিসাবটা ঠিকই ছিল।

কিছুক্ষণ সময় নিয়ে, ততক্ষণে আমি চেয়ারেই স্যারের সামনে বসেছি, তিনি বললেন: ‘ফলবান বৃক্ষ মাথা নুয়ে থাকে। যে জ্ঞানী তার বিনয়ী হতে হয়।’ মোটামুটি এই বাণীর উপর তিনি পরে তাফসিরও করলেন। তার সারাংশ দাঁড়ায় এরকম যে আমি একজন জ্ঞানী ছিলাম, ওই আমলে, কিন্তু আমি দুর্বিনীত। ফলে জ্ঞানের যে রাস্তা তাতে আমি সঠিক পথিক নই। তিনি খোঁজ নিয়েছেন অন্যদের কাছেও আমার স্বভাব বিষয়ে। আমি যেন আগামীতে বিনয় অর্জন করতে পারি সেই প্রত্যাশা তিনি করেন। স্নেহসুলভ উপদেশ দিয়ে তিনি বিরতি নেন।

আমার বুকঢিপাঢিপানির অনেক কারণ ছিল। একে তো আমার অপছন্দের স্ক্রিপ্ট ও রোল এটা। তার উপর স্বতঃপ্রণোদিত বন্ধুটির সম্মান জড়িত। তার মধ্যে এই ফলবান বৃক্ষের উপমা যোগ হয়েছে। এত ঢিপঢিপানির মধ্যেও আমার মনে হলো স্যার যেটা বললেন সেটা কমবেশি ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম্’ বাণীর একটা ফোকলোর সংস্করণ হবে। তবে এটা ঠিক যে ওই বৃক্ষের পেটভর্তি ফলের উপমাটা এর আগে আমি শুনিনি। স্যারের কথা শেষ হলে তিনি চা-ফা কিছু খেতে বলেছিলেন কিনা অত মনে নেই। তিনি মিঠা ছিলেন। কিন্তু আমার তিতা লাগছিল। তার থেকেও বড় কথা, আমার স্বতঃপ্রণোদিত দয়ালু বন্ধুটির মুখের দিকে তাকানোর দশা ছিল না। আমার ধারণা, ওর স্ক্রিপ্টে আমাদের এক্সিট রুট অত ভাল করে লেখা ছিল না। স্যারের মুখের এই ডায়ালগ সে কল্পনা করে থাকলে হয়তো এক্সিটটা স্পষ্ট জানতো সে। কিন্তু এই ডায়ালগ সে আশা করে নাই। বিশেষত এমন একজনের সামনে যার ভোগান্তি খুব সহজেই ক্যাম্পাসে তখন আলোচিত ছিল। ফলে ওই মঞ্চ থেকে আমাদের দুজনেরই সেদিন বের হওয়াটা বেশ কঠিন একটা কাজ ছিল। এখন মনে নেই যে কী বলে ও কীভাবে আমরা বের হই। কিন্তু সেটা আরামদায়ক কোনো কিছু ছিল না।

বের হয়ে বন্ধুটি আমার কাছে দুঃখপ্রকাশ করে। তার দরকার ছিল না। কারণ বিব্রত যদি হয়ে থাকে কেউ, ও আমার থেকে বেশি হয়েছিল। যদ্দুর মনে পড়ে, আমি তাকে সে কথা বলিও বটে। বন্ধুটির সাথে আর কখনো আমার মাস্টারির চাকরি নিয়ে কখনো আলাপ হয়নি। কেবল আমি আরও বছর দুয়েক পর যখন যোগ দিই সে খুশি হয়েছিল। সে আরেক অধ্যায়।

ওই ঘরে বসে আমি আমার কোনো উত্তরই মনে করতে পারি না। কেবল মনে আছে যে নিজের শান্তি হতে পারে এমন কোনো গুরুতর উত্তর আমি দিতে পারিনি। তাছাড়া ওরকম একটা স্ক্রিপ্ট হওয়াতে আমার হাতপা বাঁধাও ছিল। মানে মুখবান্ধা আরকি। আমার মাথায় ছিল যে এমন কিছু বলতে পারব না যাতে বন্ধুটির হেনস্তা হতে হয়। যতটা না চাকরির বন্দোবস্ত না হওয়াতে, তার থেকে অনেক বেশি উত্তর তেমন না-দিতে পারার কারণে শোকে মূহ্যমান হয়ে আমি ফিরি।

এরপর অনেক বছর গেছে। আমি ক্লাসরুমে গিয়ে নিজের মতো বকবক করে মাস্টারি করি। মাস্টারিতে আমার হাত-মুখ, পা-ও, পেকে গেছে। আমি একই সাথে পরম ভাল ও চরম খারাপ মাস্টার হবার জন্য আটমোস্ট কোয়ালিফাই করতে পারি। কিন্তু কখনো ওই চিত্রটা মাথা থেকে যায়নি। 

আরেকবার একই দৃশ্যে স্যারকে আর পাওয়া সম্ভব নয়। স্থান কাল পাত্র বদলে গেছে সব। স্যারও আর এই দুনিয়াতে নেই। স্যারকে আসলে কোনো একক একজন ব্যক্তি হিসেবেও আমি দেখি না। কিন্তু বলতে পারলে ভাল লাগতো: “জ্ঞানবানের ভক্তিরস আরও বিপজ্জনক স্যার। জ্ঞানবানের আনুগত্যের কারণে অন্যদের সাধারণ নাগরিক জীবন বিপন্ন হয়। আমি জ্ঞানী নই স্যার। আমি কেবল স্পষ্ট। স্পষ্টতা জ্ঞানসাপেক্ষ নয়, সংবেদসাপেক্ষ। আর সেটাই আপনাদের স্পর্ধা বলে মনে হয়।”

আদাবর। ২৭ জুন ২০২৫। ১.১৫ দুপুর

বিজ্ঞাপন দিন

আপনার বিজ্ঞাপন প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

যোগাযোগ