‘জোছনা ও জননীর গল্প’- যুদ্ধের দিন যাপনের কাব্য (পাঠ প্রতিক্রিয়া)

‘জোছনা ও জননীর গল্প’- যুদ্ধের দিন যাপনের কাব্য (পাঠ প্রতিক্রিয়া)

৫ই শ্রাবণ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

২০শে জুলাই ২০১৮

৫ই শ্রাবণ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ২০শে জুলাই ২০১৮

আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?

আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখা জমা দিন

“হঠাৎ মনে হল আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। পৃথিবী ওলট-পালট হয়ে গেছে। সারাক্ষণ কানে ঝিঁ ঝিঁ পোকার মত শব্দ হচ্ছে। আনিস সাবেত (হুমায়ূন আহমেদের বন্ধু) বাড়ির সামনের মাঠে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। তিনি শব্দ করে কাঁদছেন।গড়াগড়ি করছেন। আমি তাকে টেনে তুললাম। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, চল রাস্তায় চল। একটু আগেই তিনি কাঁদছিলেন, এখন আবার তিনি হাসছেন। আমরা রাস্তায় নেমে পড়লাম এবং ফাকা রাস্তায় কোনরকম কারণ ছাড়া দৌড়াতে শুরু করলাম। আনিস ভাই এক হাত শক্ত করে আমকে ধরে আছে, আমরা দৌড়চ্ছি।

ঢাকা শহরের সব মানুষ বের হয়ে পড়েছে। যার যা ইচ্ছা করছে। চিৎকার, হইচই,লাফালাফি। মাঝে-মধ্যেই আকাশ কাপিয়ে গর্জন।-“জয় বাংলা”, প্রতিটি বাড়িতে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উড়ছে।……

…আনিস ভাই, পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। তিনি বললেন, অবশ্যই পোলাও খাবো। পোলাও। আমরা দুজনে অর্ধ উন্মাদের মত “পোলাও পোলাও” বলে চেঁচালাম। রাস্তার লোকজন আমাদের দেখছে। কেউ কিছু মনে করছে না। একটা রিক্সাকে আসতে দেখলাম। রিকশার সিটের উপর বিপজ্জনক ভঙ্গীতে মধ্যবয়স্ক এক লোক দাড়িয়ে। তিনি জিগিরের ভঙ্গীতে বলেই যাচ্ছেন-জয় বাংলা। জয় বাংলা। জয়বাংলা।আনিস ভাই তার বিস্কিটের প্যাকেট গুড়া করে ফেললেন। আমিও ফেললাম। আমরা বিস্কিটের গুড়া ছড়িয়ে দিতে দিতে এগুচ্ছি।কোন দিকে যাচ্ছি তাও জানি না।আজ আমাদের কোন গন্তব্য নেই।”

এই প্যারাটি উপন্যাসের শেষ অংশ। না উল্লেখ করে পারলাম না এজন্য, যুদ্ধের যে দারুন এক টেনশন সমগ্র বইটিতে লেখক তুলে ধরেছেন এই অংশে এসে পাঠক উপরের চরিত্রগুলোর মতই হাফ ছেড়ে বাচবেন। সেইসাথে এটাও বলতে চাই, এই অংশটিই সবচেয়ে সুন্দর এই বইটির।

“জোছনা ও জননীর গল্প” পড়লাম। এক কথায়, এই বইটি আমার মাঝে একটা বিশাল আফসোস আরও তীব্রভাবে সৃষ্টি করেছে, আর তা হল, আমি যদি ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারতাম! যদি ১৬ই ডিসেম্বরে ঢাকার রাস্তায় স্বজন হারা অথচ বিজয় উন্মাদ মানুষদের মাঝে একজন হলেও হতে পারতাম! একজন মানুষ তার প্রতিটি কাছের মানুষকে নির্মমভাবে মরতে দেখে, দীর্ঘ দশটি মাস অসংখ্য নারকীয় ঘটনাবলীর সাক্ষী হয়ে, রোগে ক্ষুধায় মৃতপ্রায় হবার পরও আনন্দে কীভাবে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, পরমূহুর্তেই হেসে ওঠে, অপরিচিত মানুষদের নিজের সহোদরের মত বুকে টেনে নেয় ঠিক কোনরকম মানসিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারলে, তা হয়তো আমি কোনদিন অনুভব করতে পারবোনা। কারণ এমন অনুভূতির জন্ম শুধু তখনই হতে পারে যখন ব্যাক্তির আকাঙ্ক্ষায় তার নিজ স্বার্থের পরিবর্তে দেশাত্মবোধ ও স্বাধীনতাই একমাত্র কাম্য হয়ে ওঠে এবং বহু ত্যাগের বিনিময়ে তার প্রাপ্তি ও মেলে…

হূমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্পের একটি কমন এবং অসাধারণ বিষয় হল, তিনি বাঙ্গালী মুসলিমদের নাড়ি মানে “Nerve”(আজকাল তো আবার কেউ কেউ বাংলা শব্দের চেয়ে ইংরেজিটাই ভাল বোঝেন) ধরতে পেরেছেন এবং অতীব সুন্দরভাবে তার সে বোঝার ক্ষমতার প্রতিফলন ও ঘটিয়েছেন। ১৯৭১ এ বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামের মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলিম ও সরল বলতে যা বোঝায় তাই ছিল। তারা মুসলিম ব্রাদারহুডে সত্যিকার অর্থেই বিশ্বাস করত। কিন্তু যখন চোখের সামনে পাকবাহিনীর অত্যাচার দেখল তখন তাদের বোধোদয় ঘটল, এই ব্রাদারহুড সেই ব্রাদারহুড নয়। তখন তাদের উপলব্ধি হল, ধর্ম বাঁচানোর নামে আসলে ধর্মেরই বরখেলাপ হচ্ছে। লেখক তার সবগুলো মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রচনায় এমন কিছু চরিত্র তাই এঁকেছেন বা আঁকতে বাধ্য হয়েছেন (ইতিবাচক অর্থে) যেখানে কোন মাওলানা হুজুর একই সাথে “মুক্তি”দের দোষারোপ করছেন অশান্তি সৃষ্টির জন্য। আবার পাক বাহিনীর অত্যাচারকেও মেনে নিতে পারছে না। এই সব চরিত্রগুলোর মাঝে লেখক সবসময় একটি মানসিক দ্বন্দ্ব বা শীতল যুদ্ধ ঢুকিয়ে দিয়েছেন।যে যুদ্ধ চলে সমান্তরালভাবে, যেমন বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের, তেমনি এদের মাঝেও চলতে থাকে, সে যুদ্ধ মানবিকতার সাথে ধর্মের অপব্যবহারের। এবং অবধারিতভাবেই বিজয়ী হয় মানবিকতা।

হুমায়ূন আহমেদ এর লেখা পড়ে মজা পাচ্ছি আমরা, একারণেই যে তিনি একই গল্পে একই আঙ্গিকের ভিতরে নিজেও থাকেন না, পাঠককেও রাখেন না। এ যেন, মিনিট দশেক পড়াশুনার পরই এক মিনিটের ঘোরাঘুরির বিরতি। তবে অন্য কারো কেমন লাগে জানিনা, যেকোনো বর্ণনার মাঝে অনাকাঙ্ক্ষিত এবং উদ্ভট সব স্বপ্নের বর্ণনা আমার কাছে অনেক সময় ক্লান্তিকর, বৈচিত্র্য আনার পরিবর্তে একঘেয়ে লেগেছে। চিত্রনাট্য ভঙ্গীতে লেখা তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোতে প্রয়োজনীয় তথ্য বা আঙ্গিক বর্ণনার ঘাটতি অনুভব করেছি, যার জন্য পরিপূর্ণ তৃপ্তি পাইনি যতটা পেয়েছিলাম সুনীলের “পূর্ব-পশ্চিম” এর ২য় খণ্ড পড়ে।

শেষ অংশটা ভাল লেগেছে। হুমায়ূন লেখক হিসেবে এই উপন্যাসটি লিখে তার দেশমাতৃকার ঋণ শোধ করার চেষ্টা করেছেন। হুমায়ূন, আমাদের মত আমজনতার জন্য কি আপনার কোন পরামর্শ আছে এ বিষয়ে? রবীন্দ্রনাথ যেমন বর্ষা ভালবাসেন আপনিও তেমনি জোছনা ভালবাসেন। আজ আমার জানালের ওপারে জোছনার বান ডেকেছে, আপনি যদি আপনার এই প্রিয় পৃথিবীর অতি প্রিয় জোছনা পরিভ্রমণে বেড়িয়ে থাকেন, আপনাকে আমার জানালায় নিমন্ত্রণ।