সর্দার সিয়াটলের চিঠি – আমেরিকার প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে (১৮৫২)
৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
১৭ই মে ২০১৮
৩রা জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ১৭ই মে ২০১৮
আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?
আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
লেখা জমা দিনওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্ট বলে পাঠিয়েছেন যে তিনি আমাদের জমি কিনতে চান। কিন্তু আকাশ কি আপনি বেচাকেনা করতে পারেন? ভূমি? এই ধারণাটাই আমাদের কাছে আজব! আমরা যদি বাতাসের পরিচ্ছন্নতা আর জলের চকমকির মালিক না হই, তবে আমরা তা বিক্রি করব কীভাবে? এই পৃথিবীর প্রতিটি অংশই আমার মানুষের কাছে পবিত্র। পাইন গাছের প্রতিটি সূঁচালো পাতা, পোকামাকড়ের গুঞ্জন; সবই আমার জনগণের পবিত্র স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা।
গাছের দেহের ভিতরে বয়ে চলা প্রাণরস আমরা তেমনই জানি, যেমন জানি আমাদের ধমনীতে বয়ে চলা রক্তস্রোত। আমরা এই পৃথিবীর অংশ, এই পৃথিবীও আমাদেরই অংশ। সুরভিত ফুল আমাদের বোন। ভাল্লুক, হরিণ, বিরাট ঈগল; এরা আমাদের ভাই। এই পাহাড়শ্রেণী, এই সরেস তৃণভূমি, এই টাট্টু ঘোড়াটির দেহের ওম, এবং একটি মানুষ— এরা সবাই একই পরিবারের অংশ।
নদীর স্রোতে যে উজ্জ্বল জলধারা বয়ে যায় তা নেহায়েতই জল নয় শুধু, তা আমাদের পূর্বপুরুষের রক্ত। আমরা যদি আপনাদের কাছে জমি বিক্রি করি, আপনাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে তা পরম পবিত্র। হ্রদের স্বচ্ছ জ্বলে প্রতিটি অতীন্দ্রিয় প্রতিচ্ছবি আমার মানুষদের জীবনের অগুনতি ঘটনা আর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। জলের কলোচ্ছ্বাসে আমি আমার পিতা-পিতামহদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। এইসব নদীরা আমাদের ভাইয়ের মত। তারা আমাদের তেষ্টা মেটায়। আমাদের নৌকা বয়ে নিয়ে যায়, আমাদের বাছাদের মুখে খাবার যোগায়। তাই নদীর প্রতি আপনারা তেমনই সদয় হবেন, যেমন সদয় আপনারা আপনাদের ভাইদের প্রতি।
যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করি, মনে রাখবেন যে বাতাস আমাদের কাছে কত মূল্যবান! মনে রাখবেন, বাতাস তার প্রাণশক্তি দিয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছে। বাতাস আমাদের পিতামহদের প্রথম প্রশ্বাসটি দান করেছে, আর শেষ নিশ্বাসটি গ্রহণ করেছে। বাতাস আমাদের সন্তানদেরও দিয়েছে তার অফুরাণ প্রাণের অংশ। তাই, যদি আমরা আমাদের জমি বিক্রি করি, আপনারা অবশ্যই একে এমনই স্বতন্ত্র ও পবিত্র করে রাখবেন, যেন সেখানে মানুষ যেতে পারে তৃণপুষ্পের সূধাসৌরভে পুষ্ট পরিচ্ছন বায়ু সেবন করতে।
আপনারা কি আপনাদের সন্তানদের তা-ই শেখাবেন, যা আমরা আমাদের সন্তানদের শিখিয়েছি? শেখাবেন যে এই পৃথিবী আমাদের মা? যা কিছু এ পৃথিবীর কোলে আছড়ে পড়ে তা সবই তার সন্তান?
এটাই আমরা জানি: পৃথিবী মানুষের জন্য নয়, মানুষ এই পৃথিবীর জন্য। সবকিছুই রক্তসম্পর্কের মত যা আমাদের একসূত্রে গেঁথে রেখেছে। জীবনের এই জাল মানুষ বোনে নি, সে বড়জোর তার একটা সুতো মাত্র। এই জালের যেখানে সে যা-ই করুক, সে আসলে নিজেরই উপরেই তা করছে।
একটি বিষয় আমরা জানি: আমাদের ঈশ্বর তোমাদেরও ঈশ্বর। এই পৃথিবী তাঁর কাছে মূল্যবান এবং এই পৃথিবীর কোনো ক্ষতি করা তাঁর সাথেই চরম বেআদবি করার সমান। তোমাদের গন্তব্য আমাদের কাছে এক রহস্য! কী হবে, যখন সব মোষ জবাই করা হয়ে যাবে? সবগুলো ঘোড়া যখন বন্দী হয়ে যাবে? কী হবে, যখন বনভূমির গভীরতম অঞ্চল মানুষের গন্ধে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে আর সমুচ্চ পাহাড়শ্রেণী আচ্ছন্ন হয়ে যাবে কথাবলা তারে? ঘন ঝোপঝাড় কোথায় থাকবে? চলে যাবে! ঈগলেরা কোথায় থাকবে? চলে যাবে! এই টাট্টু ঘোড়া আর শিকারদের বিদায় জানানোকে কী বলব? বেঁচে থাকার সমাপ্তি আর টিকে থাকার শুরু।
যখন শেষ লাল আদিবাসী মানুষটি তার বন্যতা নিয়ে উধাও হবে আর তার তার স্মৃতি কেবলই মেঘের ছায়ার মত এই প্রেইরিতে ঘুরে বেড়াবে, এই তটভূমি আর এই অরণ্য কি সেদিন এখানে থাকবে? আমার মানুষদের একটি আত্মাও কি এখানে থাকবে?
আমরা এই পৃথিবীকে তেমনিভাবেই ভালবাসি, যেমনিভাবে সদ্যজাত শিশু তার মায়ের হৃদয়ের ধ্বনি ভালবাসে। তাই যদি আমরা আমাদের জমি তোমাদের কাছে বিক্রি করি, তোমরাও তাকে তেমনই ভালবেসো যেমন আমরা বাসি। তেমনিভাবেই এর যত্ন নিয়ো, যেমন আমরা নিয়েছি। এই ভূমির স্মৃতি যেমনটি আছে ঠিক তেমনই মনের মধ্যে ধরে রেখো। এই ভূমিকে সব সন্তানের জন্য রক্ষা কোরো ও ভালবেসো, যেমন ঈশ্বর আমাদের বাসেন।
আমরা যেমন এই ভূমির অংশ, তোমরাও তেমনই। এ পৃথিবী আমাদের কাছে মূল্যবান। তেমনি মূল্যবান তোমাদের কাছেও। একটি কথা আমরা জানি: একজনই ঈশ্বর। সাদা-কালো মানুষে মানুষে ভেদ নেই কোনো, ভেদ শুধু মানুষের সাথে তাঁর। আমরা সবাই সবার ভাই।