রমা চৌধুরীর পায়ের কাছে একদিন

রমা চৌধুরীর পায়ের কাছে একদিন

২০শে ভাদ্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৮

২০শে ভাদ্র ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৮

আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?

আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখা জমা দিন

চট্টগ্রামের যেখানে রমা চৌধুরী থাকতেন, সেখানে একবার গিয়েছিলাম। শীতের সন্ধ্যা ছিল সেটি। তিনি যেই জীর্ণ বিল্ডিংয়ে থাকতেন সেটির নিচতলায় বাঁধাইখানা, বইয়ের দোকান, প্রেসের পুরাতন কলকব্জা বিক্রির দোকান ছিল মনে পড়ছে।

অমসৃণ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে বারকয়েক ধাক্কা খেলাম। নির্দিষ্ট তলায় গিয়ে আলাউদ্দিন খোকনকে ফোন করলাম। তিনি জানালেন, তার ফিরতে খন্টাখানেক লাগবে। আলাউদ্দিন খোকনের পরামর্শ মতো নির্দিষ্ট রুমে গিয়ে দরোজায় টোকা দিতেই ‘কে? ভিতরে আসেন’ বলে একজন ডাকলেন। ভেতরে পা বাড়াতে গিয়ে দেখলাম ফ্লোরে পাটের চট বিছানো আছে। জুতো খুলে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

এক কামরার ছোট্ট ঘর। প্রায় পুরো অংশ জুড়েই একটি খাট। তিনদিকের দেয়াল বইঘেরা। খাটের একপাশে ছোট্ট টেবিল। টেবিল জুড়ে ছড়ানো ছিটানো ঔষধের প্যাকেট, খাবার থালা ও পানির গ্লাস। টেবিলের নিচে আরও গোটা দুই থালা। তাতে দুধভাত মাখানো। পরিচয় জানতে চাইলেন -‘আপনি কে বাবা?’ নিজের নাম বললাম। আমাকে বিছানায় বসতে বললেন। তারপরে একেএকে তাঁর কথার ঝাঁপি খুলে বসলেন। আমি হাতে করে সামান্য ফল নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই প্যাকেটটা সংকোচে তাঁর হাঁটুর কাছে নামিয়ে রাখলাম। তিনি লজ্জিত হয়ে সামান্য হাসলেন। খাটের নিচ থেকে একটা টিনের কৌটা বের করে আনলেন। বিস্কুট বের করে আমাকে খেতে দিলেন। পানির জগ দেখিয়ে বললেন-‘জলটা নিজেই ঢেলে নাও বাবা’। হাতে শক্তি কম। মাঝেমাঝে কাঁপে।

আমাদের কথার মাঝখানেই খাটের নিচ থেকে একটি বিড়াল বেরিয়ে আমার শরীরে নাক ঘষতে লাগলো। আমি হাত পা দ্রুত টেনে সোজা হয়ে গেলাম। রমা চৌধুরী হাত বাড়িয়ে বিড়ালটিকে শাসনের সুরে ডাকলেন। বিড়ালটি আমাকে ছেড়ে তাঁর কোলের মধ্যে গিয়ে বসে মিঁউমিঁউ করতে লাগলো। এরপরে আরও একটি বিড়াল লাফিয়ে নামলো বইয়ের সেলফ থেকে। আমার আতঙ্কিত মুখ থেকে তিনি বললেন- ওরা আমার সন্তান। আমি এখন ওদেরকে নিয়েই থাকি। কোলে বসা বিড়ালটি নেমে টেবিলের নিচে দুধভাতের থালায় মুখ দিয়ে মিঁউমিঁউ ডাকতে লাগলো। রমা চৌধুরী বিছানা থেকে নেমে পাশের ছোট্ট ডেকচি থেকে থালার মধ্যে খানিকটা দুধ ঢেলে ভাতটুকু আবার মেখে দিলেন। এবার বিড়ালটি মনোযোগ গিয়ে খেতে শুরু করলো।

চলে আসার আগে তাঁর লেখা দুইটি বই স্বাক্ষর করে দিলেন। ঘর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। আমার হাতে জুতো দেখে বললেন- বাইরে শীতের রাত, ঠান্ডা করবে। এবার জুতো পায়ে বাসায় যাও বাবা। একবার ভাবি যে তাঁকে বলি- আপনি যে প্রায় চার দশক খালি পায়ে হেঁটে চলেছেন….। কিন্তু তাঁকে কিছুই বলতে পারি না। নিচে নেমে আসি। অমসৃণ সিঁড়ি খালি পায়ে বেশ ভালোরকম যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। নিচে নেমে সোজা চেরাগী পাহাড়ের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। চেরাগী মোড় থেকে জামালখানের দিকে। প্রেসক্লাব ভবনে বাতিঘর পেরিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে ঢুকবো বলে এগিয়ে যেতে থাকি। কিন্তু হাতের জুতোর দিকে চেয়ে আবার সামনে হাঁটা শুরু করি। খাস্তগীর গার্লস স্কুল পেরিয়ে বামে মোড় নিয়ে কাজীর দেওড়ীর দিকে এগিয়ে যাই। আশকার দীঘি পর্যন্ত আসার পরে পায়ে টনটন যন্ত্রণা হতে লাগলো। সেখানে একটি ফার্ণিচারের দোকানের সামনে গিয়ে একটি চেয়ারে বসে পড়ি। তারপরে একটি সিএনজি অটোরিক্সা ডেকে খুলশীর দিকে এগিয়ে যাই। অটোরিক্সায় চড়েও জুতা হাতেই বসে থাকি। টাইগার পাসের নির্জন রাস্তায় শীতের বাতাস অটোরিক্সার গ্রীল দিয়ে হুহু করে বইতে থাকে। সেই বাতাসে আমার কাঁপুনি ও চলমান গাড়ির দুলুনিতে বারবার রমা চৌধুরী আমার সামনে ভাসতে থাকেন।

রমা চৌধুরীর সাথে আলাপের সময় বলেছিলাম, আপনার শেষযাত্রার শব বহনকারীরা খালি পায়ে হেঁটে গেলে আপনি খুশী হবেন কি? জবাব দিতে গিয়ে রমা চৌধুরী খানিক সময় নিলেন। তারপরে লজ্জিত হওয়ার মতো করে সামান্য হেসে বললেন- এটা খুব বড় দাবী হয়ে যায় না, বাবা?