সাগরের গতি

সাগরের গতি

৩রা আশ্বিন ১৪২৫ বঙ্গাব্দ

১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৮

৩রা আশ্বিন ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ১৮ই সেপ্টেম্বর ২০১৮

আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?

আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।

লেখা জমা দিন

শরীরটা আজকাল আর কিছুতেই ভালো যায় না। সেই ঘোড়ার গাড়ি উল্টে পড়ার সময় থেকেই। ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার বলেছিলেন, লিভারে চোট লেগেছে। সাবধানে থাকতে হবে। সাবধান! এ জন্মে সে আর হয়ে উঠল না। মাঝেমধ্যে পেটের বাঁদিকে একটা অসহ্য ব্যথা ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে প্রাণপণে সেই ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করেন। কোনও কোনও সময় ব্যথা কমে যায়। কখনো আবার কমেও না। লোক পাঠাতে হয় মহেন্দ্রলাল কিংবা ডাঃ কেরির কাছে। ইদানিং বেশ ঘনঘনই লোক পাঠাতে হচ্ছে। নিজের জন্য অন্যদের ব্যতিব্যস্ত করতে খুব কুণ্ঠা হয় তার। তাই যতক্ষণ পারেন, দমবন্ধ করে চেষ্টা করেন সহ্য করার। কিন্তু আজকাল যেন সেখানেও হেরে যাচ্ছেন বারবার। হেরে যাওয়াটাই যেন তার ভবিতব্য হয়ে গেল। দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন তিনি। একে একে সবাইকে হয় তিনি ছেড়েছেন, আর নয়তো তারাই ছেড়ে গেছে। পরিবার বলেও আর কিছ অবশিষ্ট নেই তার। অন্তরঙ্গ বলতে এক শুধু পড়ে আছে রামতনু। বয়সে খানিক বড় হলেও সখ্যতা আন্তরিক। তাও বহুদিন দেখা হয় না তার সঙ্গে। অবসর নেবার পর সেও এখন তাদের সমাজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত।

ভাদ্রের ভ্যাঁপসা গরমে সর্বাঙ্গ যেন জ্বলে যাচ্ছে। শীতগ্রীষ্ম নিয়ে আদেখলেপনা তার কোনোদিনই ছিল না। কিন্তু আজকাল যেন তারাও দাঁতনখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আসলে উল্টোদিকের মানুষটা কমজোরি বুঝলে নিরীহ বিড়ালছানাও সাহস পেয়ে যায়। কমজোরি হওয়াটা অবশ্য খুব অস্বাভাবিক নয়। আর কতটা আঘাত পেলে একটা মানুষ উন্মাদ হয়ে যেতে পারে! তার থেকেও বেশি? রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির মুখে একটি মাঝবয়েসী পাগল দিনরাত নাচানাচি করে। প্রশ্ন করে জেনেছিলেন, একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর শোক লোকটি নাকি আর সহ্য করতে পারেনি। রাজকৃষ্ণও বলেছিলেন, ‘সন্তানশোক বড় কঠিন, সহ্য করা যায় না’। কোনও উত্তর দেননি তিনি। রাজকৃষ্ণ কি জানেন, মাত্র তিনমাস আগে নিজের হাতে লিখে উইল করে ফেলেছেন তিনি? আত্মীয়-অনাত্মীয় সমস্ত আশ্রিতের জন্যই মাসোহারার বন্দোবস্ত আছে তাতে। বাদ শুধু একমাত্র পুত্র। তাকে তিনি ত্যাজ্যপুত্র করেছেন। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গেও আর কোনও সম্পর্ক নেই, শুধু মাসিক একটা টাকা পাঠিয়ে দেওয়া ছাড়া।

ভুল এক দেশে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। এই দেশের মানুষ মাটিতে গড়াগড়ি যেতে খুব ভালবাসে, সোজা হয়ে দাঁড়াতে জানে না। শুধু তাই নয়, যারা সেই চেষ্টা করে, তাদের নামে কাদা ছিটিয়ে বিমল আনন্দ উপভোগ করে। কেচ্ছা আর রস, এছাড়া এই দেশের মানুষ আর কিচ্ছু জানে না। হ্যাঁ, তার মধ্যেও দু-চারজন উঠে দাঁড়ায় বৈকি। বাকিরা প্রাণপণ চেষ্টা করে কি করে তাদের ছোট করবে। রাজার মতো মানবসিংহের নামেও এরা ছড়া বেঁধেছিল। তিনি অবশ্য ভ্রূক্ষেপই করেননি। তার নিজের নামেও কি করেনি? শোভাবাজার-দত্তপাড়ার মাতব্বররা কুৎসা ছড়িয়েছিল, অসহায় মেয়েদের উদ্ধার করার নামে তিনি নাকি আসলে তাদের নিয়ে মজা লুটছেন। তখন একটা অন্য সময় ছিল। চারপাশে কত মানুষ! শরীর আর মনে জোরও ছিল অসীম। তাই তাকানোর সামান্য চেষ্টাও করেননি। আজ তিনি একা, নিঃসঙ্গ। মনের কথা বিনিময় করবেন, এমনও তো কেউ নেই তেমন। দেনায় ডুবে আছেন। কীভাবে পরিশোধ করবেন, ভেবে পান না। আর যাদের জন্য দেনা হলো, তারাও মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে অবলীলায়।

সেই ঘোড়ার গাড়ি উল্টে তিনি মাটিতে চিৎপাত হয়ে পড়েছিলেন, সাময়িক জ্ঞান ছিল না। অন্য একটা গাড়িতে ডি আই সাহেবের সঙ্গে ছিলেন মিস কেরি। তিনিই লাফ দিয়ে নেমে এসে অচৈতন্য তার মাথা তুলে নিয়েছিলেন কোলে, ঐভাবেই বসেছিলেন রাস্তায়। ব্যাস, ফের কেচ্ছা। বুড়ো পণ্ডিত এখন মেমসাহেবের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। হু হু বাবা, আমরা কি কিছুই বুঝি না! এতই যদি নারীপিরিত, নিজের বৌকে ফেলে রাখলে কেন বাবা সেই ধ্যারধ্যারে গোবিন্দপুরে? তাঁকে কলকেতায় নিয়ে এলে যে তোমার কেষ্টলীলায় ব্যাঘাত ঘটবে। শুনে গুম মেরে বসেছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল আত্মহত্যা করেন। দিনময়ীর কাছে যদি সংবাদটা যায়, সেই বা কী মনে করবে ভেবে বড় অস্থির হয়ে পড়েছিলেন। সেই একবারই। খানিকক্ষণের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। কিন্তু আজকাল যেন আর লড়াই করার স্পৃহা আর পান না। বেঁচে থাকাটাই অনর্থক মনে হয়। যে উদ্যম নিয়ে জীবনের দৌড়টা শুরু করেছিলেন, সেটাই যেন মিলিয়ে গেছে হাওয়ায়।

ব্রাহ্ম সমাজের একজন প্রচারকের আসার কথা ছিল। তার জন্যই অপেক্ষা করছেন তিনি। তাঁকে পথ চিনিয়ে নিয়ে আসবে সমাজেরই অন্তর্ভূক্ত একটি ছেলে, নাম শ্রীশচন্দ্র। বিডন স্ট্রিট থেকে আসতে আর কতটুকু সময় লাগে? অথচ ইতিমধ্যেই চল্লিশ মিনিট পার হয়ে গেছে। প্রবল বিরক্তি লাগে তার। সময়ের মূল্য এখনো শিখল না এই পোড়া দেশের মানুষ। যারা নিজেদের আলোকিত বলে মনে করে, তাদেরো সেই গদাইলস্করি চাল। না, এইবার কাজে বসতে হবে। সংস্কৃত প্রেসের মালিকানার অর্ধেকটা বিক্রি করে দেবার পর ধকলটা অনেকটাই বেড়েছে। আর অপেক্ষা করা যাবে না। তিনি উঠে পড়েন।

ঠিক সেই সময়ই দরজায় মুখ দেখাল শ্রীশচন্দ্র। একগাল হেসে বলল, ‘আজ্ঞে, পথ গুলিয়ে ফেলেছিলুম’। বিরক্তি চেপে তিনি হাসিহাসি মুখেই বললেন, ‘তাই তো, বিডন স্ট্রিট থেকে বাদুড়বাগান আসতে এত পথ ভুল হয়, আর অন্য মানুষকে পৃথিবী ছেড়ে একেবারে পরলোকের পথ পর্যন্ত চিনিয়ে দিচ্ছেন?’ প্রচারক ভদ্রলোক বুদ্ধিমান, বুঝে ফেললেন তার বিরক্তি। তাই করজোড়ে বললেন, ‘আপনার মতো অভিভাবক আছে বলেই না আমরা পথ হারানোর বিলাসিতা করতে পারি’। এরা আর কিছু না পারুক, মন জোগানো কথা বলতে ওস্তাদ। রাজার সঙ্গে তুলনা করলেই বোঝা যায়, সেই মানুষটাও ছিলেন এদের সঙ্গে বেমানান। মুখটা গম্ভীর করে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন, কী প্রয়োজনে আসা’। না, তেমন কিছু নয়, শুধু তাঁকে দেখতে, তার সঙ্গে কথা বলতেই এসেছেন। অসহ্য। তিনি কি বিগ্রহ, যে লোকে এসে ফুলপাতা চড়িয়ে যাবে? নেহাত ভদ্রতার দায়ে অল্পস্বল্প কথা বলে চলেন তিনি। না, এইবার বিদায় করতেই হবে।
মুখটা তুলে তাকাতেই চোখে পড়ল ঘরে ঢুকছেন রামতনু, রামতনু লাহিড়ী। ‘কী আশ্চর্য! পথ ভুলে এলে নাকি?’

‘না হে, ভাবি তো আসবো; আর পেরে উঠি না। শ্বাসকষ্টটা আজকাল বড্ড বেড়েছে। তোমার এখন কী অবস্থা?’

রামতনু লাহিড়ীকে সাক্ষাৎ দেখে প্রচারক আর তার সঙ্গী বুঝে ফেলেছেন, এইবারে বিদায় নিতেই হবে। তাঁরা উঠে পড়লেন। তিনিও প্রতিনমস্কার করলেন। তারপর রামতনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমাকে খুব বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে যে? কোনও বিপদ হলো নাকি?’

‘বিপদ মানে!’, রামতনু শরীর এলিয়ে দিলেন। ‘আমার অবিলম্বে একটি ব্রাহ্মণ পাচক চাই। যিনি ছিলেন, জবাব দিয়েছেন’।

তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘তুমি তো জাত মানো না। তবে ব্রাহ্মণ পাচকের কী দরকার?’

রামতনু লজ্জিত মুখে বললেন, ‘আমার নয়, ব্রাহ্মণ পাচক না হলে গৃহিণীর চলবে না’।

তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘বাপের কথায় পৈতেগাছটা রাখতে পারলে না; এখন পরিবারের কথায় বামুন খুঁজতে বেরিয়েছ?’

রামতনু জানেন বয়সে কনিষ্ঠ হলেও এই সুহৃদের মুখে কিছু আটকায় না। তাই গা না করে তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘দক্ষিণেশ্বরের সেই ঠাকুর নাকি এসেছিলেন তোমার কাছে?’
তিনি চোখ বন্ধ করলেন। সেইভাবেই উত্তর দিলেন, ‘হুম’।

‘তাঁর চ্যালারা তো ঢাকঢোল পেটাতে শুরু করে দিয়েছে, তিনি নাকি তোমায় বশ করে ফেলেছেন’।

কথাটা শুনেই তিনি হেসে ফেললেন, ‘কত লোকই তো আমায় বশ করল’।

রামতনু আচমকা গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ‘আমাদের বিজয়কৃষ্ণ আর কেশবকে তো তিনি গ্রাস করে ফেলেছেন। এখন হয়তো তাই তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছেন’।

‘ওদের কথা ছাড়ো। দুজনাই আদ্যন্ত কাপুরুষ আর মিথ্যাচারী’, তিনি যেন গর্জন করে উঠলেন। ‘কেশবের তো তার সঙ্গে আছে নামজাদা হবার লোভ। ওরা সব পারে’।

দুজনেরই প্রতি তাঁর মনে জমে আছে অপরিসীম ঘৃণা। বিজয়কৃষ্ণ প্রথম বিধবাবিবাহের আসরে উপস্থিত হবে কথা দিয়েও শুধু যে আসেনি তাই নয়, আড়ালে ঘোঁট পাকানোরও চেষ্টা করেছিল। আর কেশব! ছেলেটিকে তিনি বড্ড স্নেহ করতেন। বাল্যবিবাহ রদের যে দরখাস্ত করা হয়েছিল বড়লাটের কাছে, তাতে স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য কম দৌড়োয়নি কেশব। অথচ কোচবিহারের রাজবাড়ি থেকে যেই তাই নাবালক কন্যার সম্বন্ধ এল, এক কথায় রাজি হয়ে গেল। এই দ্বিচারিতা সহ্য হয় না তার। তারপর থেকেই তাদের এড়িয়ে চলেন।

‘তা হঠাৎ তিনি চলে এলেন যে?’ রামতনুর খুব আগ্রহ বিষয়টা নিয়ে। সে অবশ্য হবারই কথা। তার সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজের মানুষদের সখ্যতা চিরকালই বেশি। এখন ব্রাহ্ম সমাজও তিন টুকরো। ফলে তাদের জোর কমেছে। তাদের স্বাভাবিক মিত্র তিনিও যদি এখন উল্টে যান, তাহলে তো ব্রাহ্ম সমাজের মুখ পুড়বে।

‘হঠাৎ নয়, আমিই আসতে বলেছিলাম’।

‘তুমি! তোমার হঠাৎ এমন শখ জাগল?’ রামতনু যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না।
‘কেন, আমার কি ধর্মকথা শুনতে সাধ হতে পারে না?’ তিনি মুচকি হাসেন।
রামতনু মুখটা কেমন একটা করে বললেন, ‘সে হতেই পারে। পৃথিবীতে কত কী হয়। মড়া মানুষেরও বিবাহের সাধ জাগে শুনেছি’।
তিনি হেসে ফেললেন। মনের ভিতরের গুমোটটা যেন কেটে যাচ্ছে। বললেন, ‘তেমন কিছু নয়। আমাদের স্কুলের শ্যামপুকুর ব্রাঞ্চের হেড মাস্টার হলেন মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত। তিনি নিয়মিত দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করেন। গত মাসে একদিন ইস্কুলে গিয়েছি তদারকিতে। প্রবল বৃষ্টি। বেরুতে পারছি না। তাই কথা হচ্ছিল তার সঙ্গে। একথা সেকথার পরে বললেন, দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণদেব নাকি আমার খুব সুখ্যাতি করেন। কী বলি! ভদ্রতার খাতিরে তার সম্পর্কে দু-চারটি প্রশ্ন করলাম’।
‘হঠাৎ তিনি বললেন, “ঠাকুর আপনার সঙ্গে খুব দেখা করতে চান। কলকেতার নানান বড় মানুষের সঙ্গে তিনি নিজে গিয়েই কথা বলেছেন । কিন্তু আপনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ তাঁর হয়নি”। সাধুসন্ন্যাসীদের সঙ্গে কথা বলতে আমার ইচ্ছে হয় না, সে তো জানোই। তাই তাঁকে সেই কথাটাই বললাম। কিন্তু মহেন্দ্রনাথ নাছোড়বান্দা। বললেন, “আপনি যেমন ভাবছেন, তিনি তেমন সন্ন্যাসী নন। তিনি গেরুয়া পরেন না, কমণ্ডূলু-চিমটে নিয়ে ঘোরেন না। একবার কথা বলে দেখুন না”। অগত্যা রাজি হলুম’।

‘হ্যাঁ, তোমার তো আবার না বলার দম নেই’, রামতনু হাসতে হাসতে বললেন। ‘তারপর সব বলো তো’।

তিনি বিষণ্ণ একটা হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন, ‘তিনি এসেছিলেন ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত শনিবার’।

সিঁড়ি দিয়ে রামকৃষ্ণ যখন উঠে আসছিলেন, তখন দোতলার এই ঘরের বেঞ্চে রোজকার মতোই কয়েকজন সাহায্যপ্রার্থী বসে ছিল। মহেন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকেই বললেন, ‘ঠাকুর এসেছেন’। শুনেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন, হাতজোড় করে নমস্কার করলেন। রামকৃষ্ণও নমস্কার জানালেন। কিন্তু কোনও কথা না বলে চোখ দিয়ে যেন ঘরটাকে আদ্যোপান্ত জরিপ করতে লাগলেন। তিনি হাত দেখিয়ে ইঙ্গিত করে বেঞ্চে বসতে বললেন। না বসেই রামকৃষ্ণ বিড়বিড় করে কী যেন বলে যাচ্ছেন। আচমকা দুলতে শুরু করলেন তিনি। মহেন্দ্রনাথ ফিসফিস করে বললেন, ‘ঠাকুরের ভাবসমাধি হয়েছে’।
ভাবসমাধি! সে যাই হোক, তার বাড়িতে প্রথম দিন এসেই কারো যদি এমন দশা হয়, দায় তো তার উপরই পড়বে। তিনি তাই মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী করবেন?’

মহেন্দ্রনাথ একগাল হেসে আশ্বস্ত করলেন, ‘ব্যস্ত হবেন না। অমন ভাবসমাধি ঠাকুরের ঘনঘন হয়। এখানে এসে তিনি বড় আনন্দ পেয়েছেন বোঝা যাচ্ছে’।

সেই কথা শুনেই কিনা কে জানে, রামকৃষ্ণ সহসা যেন জ্ঞান ফিরে পেলেন। হেসে বললেন, ‘একটু জল দাও না গা’।
তিনি ব্যস্ত হয়ে ভিতরে গেলেন জল আনবার জন্য। ফুলকাটা ঘটিতে আনা জল রামকৃষ্ণ ঢকঢক করে খেয়ে নিলেন। তারপর ঘটিটা হাতে তুলে দিতে দিতে একগাল হাসি দিলেন তার দিকে তাকিয়ে। তিনিও নরম গলায় বললেন, ‘বেঞ্চে বসুন’।
বেঞ্চের একদম সামনের দিকে একটি ছেলে বসে ছিল। ছাত্র, দরিদ্র পরিবার। তাই তার কাছে এসেছে একটা কিছু হিল্লে করে দেবার জন্য। রামকৃষ্ণের হাল দেখে সে আর কথা পারবার সুযোগ পায়নি। তিনি ধাতস্থ হয়ে বেঞ্চে বসছেন দেখে আর সে সুযোগ নষ্ট করল না। হাতজোড় করে নিজের কাহিনী বলতে শুরু করল। রামকৃষ্ণ বেঞ্চে বসে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলেন, ‘ও মাস্টার, আমার গা এমন জ্বলে কেন গা?’

মহেন্দ্রনাথ কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি নিজেও চোখ ঘুরিয়ে নিলেন রামকৃষ্ণের দিকে। এমন অস্থির অস্থির করছেন কেন? হঠাৎই রামকৃষ্ণ বলে উঠলেন, ‘মা, এ ছেলের বড় লোভ। সংসার ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। মাগো, তোমার অবিদ্যার সংসার, এ অবিদ্যার ছেলে’। ছেলেটি লজ্জা পেয়ে গেল। আচমকা উঠে পড়ল। নমস্কার করে বলল, ‘মাপ করবেন, আমি পরে একদিন আসব’।

বড় বিরক্ত হলেন তিনি। এমন অজস্র মানুষ রোজ আসে তার কাছে। কী করবে বেচারারা? এত দারিদ্র্য মানুষের। এই দেশ আর সমাজ তো তাদের মাথা উঁচু করে লড়াই করতে শেখায়নি। শিখিয়েছে হয় ঠাকুরদেবতার কাছে মাথা কুটতে, আর নয়তো বড় মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে। এদের নিয়েই তো আছেন তিনি। তিন বছর আগেই তো খরায় সব নষ্ট হয়ে গেলে ভাই শম্ভুচন্দ্রকে দিয়ে গ্রামে অন্নসত্র খুলিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, একটি মানুষও যেন অনাহারে মারা না পড়ে। কুড়ি হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেল। তিনি কি তাহলে অন্যায় করেছিলেন? বিরক্তিতে মুখটা সামান্য কুঁচকে উঠল তার।

রামকৃষ্ণ হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন তার মনের ভাব। তাই সঙ্গে সঙ্গে একগাল হেসে বললেন, ‘আজ সাগরে এসে মিললাম। এতদিন খাল-বিল-হদ্দনদী দেখেছি। এইবার সাগর দেখছি’।

তিনিও সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন, ‘তবে নোনাজল খানিকটা নিয়ে যান’।

‘নোনা জল কেন? তুমি তো অবিদ্যার সাগর নও। বিদ্যার সাগর। তুমি ক্ষীরসমুদ্র’।

এমন স্তুতিবাক্য তিনি প্রতিদিন শোনেন। যারাই হাত পাততে আসে তারাই তাকে শোনায়। এই মানুষটিও কি তাহলে হাত পাতবেন শেষে? না, নিজের মনেই বকবক করে যাচ্ছেন। কত কথা, বেদ-বেদান্ত এইসব। বোঝাই যাচ্ছে বেশ ভালোমতই তৈরি হয়ে এসেছেন। তিনিও বাধা দেন না। প্রশ্নও করেন না। রামকৃষ্ণ বোধহয় খেয়াল করলেন যাকে উদ্দেশ করে এতকিছু বলে যাচ্ছেন, তার মুখে কোনও কথা নেই। তাই আচমকা সরাসরি প্রশ্ন করে বসলেন, ‘তোমার কিসের ভাব গা?’

তিনি সচরাচর ধর্ম বিষয়ে কোনও বাদানুবাদ বা আলোচনায় যান না। এই পোড়া দেশে ধানচাল বা মানুষের দুর্দশা কীভাবে ঘোচানো যায়, সেই বিষয়ে কোনও কথা না হলেও ধর্ম নিয়ে কথা হয়েছে প্রচুর। এতটাই যে বদহজমের ঢেঁকুর দেশটাকে মাত করে রেখেছে। ধর্মের কথা শুনলেই বিরক্তি আসে তার। ব্রাহ্ম সমাজের লোকদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ধর্মের কারণে নয়। তার নানান উদ্যোগে এরাই তাকে সহযোগিতা করেন। এদের ধর্মের বাণীও সেই বুড়বুড়ি। মানুষের সঙ্গে যোগ নেই, তাদের দুঃখদুর্দশার প্রতি কোনও নজর নেই, খালি পরমপিতার নাম করে ওজস্বিনী বক্তৃতা। কিন্তু রামকৃষ্ণ অতিথি, তায় তিনি এলেবেলে কেউ নন। কলকেতা শহরের নানান গণ্যমান্য লোকেরা তার ওখানে মাথা ঠোকে। তার প্রশ্নকে অবহেলা করা যায় না। তাই তিনি মুচকি হেসে বললেন, ‘সে আমি আপনাকে একদিন একা একা বলব’।

ব্যাস, আবার চালু হয়ে গেল রামকৃষ্ণের টানা ভাষণ। কখনও বা গান গাইছেন। কখনো আবার সেই ভাবসমাধি হচ্ছে। ঘরের মধ্যে যেন প্লাবন বয়ে যাচ্ছে। খবর পেয়ে বাড়ির লোকেরাও ভিড় জমিয়েছে ঘরে। অস্বস্তি হয় তার। আর কতক্ষণ চলবে এই সব? কত কাজ বাকি পড়ে আছে। হঠাৎই রামকৃষ্ণ বলে উঠলেন, ‘তোমার কর্ম সাত্ত্বিক কর্ম। সত্ত্বের রজঃ। সত্ত্বগুণ থেকে দয়া হয়। দয়ার জন্য যে কর্ম করা যায়, সে রাজসিক কর্ম বটে– কিন্তু এ রজোগুণ– সত্ত্বের রজোগুণ, এতে দোষ নাই। শুকদেবাদি লোকশিক্ষার জন্য দয়া রেখেছিলেন– ঈশ্বর-বিষয় শিক্ষা দিবার জন্য। তুমি বিদ্যাদান অন্নদান করছ, এও ভাল। নিষ্কাম করতে পারলেই এতে ভগবান-লাভ হয়। কেউ করে নামের জন্য, পুণ্যের জন্য, তাদের কর্ম নিষ্কাম নয়। আর সিদ্ধ তো তুমি আছই’।

তার থেকে বয়সে অন্তত পনেরো-ষোল বছরের ছোট একজন তাকে সরাসরি নাম ধরে ডাকবে, একটা তার হজম হয় না। সাহেবরাও তাকে রেয়াৎ করে কথা বলতো। অত বড় চাকরিটা দুম করে তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু এই মর্যাদার প্রশ্নেই। কত আর বয়েস তখন তার? চল্লিশও হয়নি। পারবে এই মানুষটা, মতে না পোষালে রাসমণির মন্দিরকে এক কথায় বাতিল করে দিতে? অন্যের আশ্রয়ে থেকে বড় বড় বোলচাল দেওয়া ধর্মের পাণ্ডাদের চিরকালীন স্বভাব। তবুও প্রতিবাদ না করে বললেন, ‘আমি সিদ্ধ । কেমন করে?’

‘আলুপটল সিদ্ধ হলে তো নরম হয়। তা তুমি তো খুব নরম। তোমার অত দয়া’।

‘কলাইবাটা সিদ্ধ তো শক্তই হয়’।

না, রামকৃষ্ণ কিন্তু হাজির-জবাব। এই গুণটা তার পছন্দ হয়। আর আত্মবিশ্বাস। এই যে ঈশ্বর-ঈশ্বর বলে তার নাম ধরে ডাক পাড়ছেন, সেটাও তার ঐ আত্মবিশ্বাস থেকেই এসেছে। এখন তিনি যদি পাল্টা কিছু বলেন, তাহলে কালই প্রচার হয়ে যাবে, বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে এনে তিনি অপমান করেছেন। এই বাড়ু্য্যে-সন্তানের নামে নিন্দা শুনতে পেলে কলকেতার মানুষদের বড় আনন্দ হয়। থাক। কতক্ষণই বা আর থাকবেন! সেওটুকু হাসিমুখে সামলে নিলেই হলো।

রামকৃষ্ণেরও এবার বোধহয় শখ মিটেছে। বললেন, ‘এবারে তাহলে চলি গোঁ ঈশ্বর। আমাদের রাসমণির মন্দিরের ফুল বাগান দেখতে এসো একদিন’।

‘নিশ্চয়ই যাব। আপনি এসেছেন, আমিও নিশ্চয়ই যাব’।

রামকৃষ্ণ যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, মুখে তার বিজয়ীর হাসি। মহেন্দ্রনাথের মুখও উজ্জ্বল। তার গুরু যে এই কেঠো মানুষটাকে বশ করে ফেলেছে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তিনি মনে মনে হাসেন। একবার শুধু গলা নামিয়ে মহেন্দ্রনাথকে জিজ্ঞাসা করেন, গাড়িভাড়া দিতে হবে কিনা। মহেন্দ্রনাথ জানালেন, সে ব্যবস্থা হয়ে গিয়েছে।

‘কি মনে হলো তোমার?’ রামতনু জিজ্ঞাসা করলেন।

তিনি চোখ মেললেন। সামান্য হেসে বললেন, ‘মানুষটি সরলসিধা, যা বিশ্বাস করেন, সেটাই বলেন। আর ভাষাও সাধারণ মানুষের মতোই। তোমাদের আচার্যদের মতো গ্রামভারী নয়’।

‘আর? তোমার কাছে কেন এসেছিলেন বলে মনে হয়? কোনও আবদার করেননি?’

‘না। জাগতিক লোভ খুব একটা নেই। অন্তত আমার তুলনায় তো বটেই’।

‘তুমি কি ঠাট্টা করছ নাকি? তোমার আবার লোভ আছে নাকি?’

‘আছে তো বটেই। এতগুলো পুষ্যি পালতে গেলে লোভ তো থাকতেই হবে। রামকৃষ্ণের সেই টুকুও নেই’।

‘কারণ নিশ্চয়ই তাকে পুষ্যি পালতে হয় না। বরং অন্যেরাই তার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে’, রামতনু ফোঁস করে ওঠেন।

তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মানুষটাকে দেখে লোভ হলো বৈকি আমার। অমন জীবন যদি যাপন করতে পারতাম’।

‘কী বলছ তুমি!’ রামতনু যেন আকাশ থেকে পড়লেন।

‘সারাটা জীবন লড়াই করে করে আমি শূন্য হয়ে গেছি রামতনু। আজ মনে হচ্ছে, এই পোড়া দেশে এইসব না করে যদি মিষ্টি মিষ্টি ভক্তির কথা বলতে পারতাম, তাহলে অন্তত এমন একা হয়ে যেতাম না। অন্য কারো দায়িত্ব নিয়ে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হতো না। উল্টে রাজামহারাজারা আমায় খাতির করে পালতো’।

‘কী আর করবে? যে পথ তুমি বেছে নিয়েছ, তার দাম তো তোমাকে দিতেই হবে’, রামতনু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। ‘তাহলে তিনি কেন এসেছিলেন বল তো? স্রেফ তোমায় কিছু জ্ঞান দিতে?’

‘আমার কাছে তো তোমার মতো দুয়েকজন ছাড়া আর কেউ এমনি এমনি আসে না। উনিও আসেননি’।

‘ওনার দাবীটা কী?’

‘উনি এসেছিলেন আমাকেই কিনে নিতে’।

‘পারলেন?’

তিনি কোনও উত্তর দিলেন না। খানিকক্ষণ পরে বললেন, ‘তোমার ব্রাহ্মণ পাচকের সন্ধান হলো?’

রামতনু বুঝলেন, আর কোনও কথা বলতে চাইছেন না তিনি। তাকেও উঠতে হবে। তাই প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি যাবে নাকি দক্ষিণেশ্বরে?’

বিদ্যাসাগর চেয়ার থেকে উঠে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন বইয়ের র‍্যাকের দিকে। পাণ্ডুলিপি সংশোধনের কাজে এবার হাত দিতেই হবে। আচমকা ফিরলেন রামতনুর দিকে। দুই পা এগিয়ে এলেন। তারপর কেমন এক রহস্যমাখা গলায় বললেন, ‘সাগর কি কোথাও যায় রামতনু? পৃথিবীর সমস্ত নদীই বরং দৌড়ে চলে সাগরে এসে মিশবে বলে’।