সব চামড়ায় ঢেকে দাও (ব্রেনে ব্রাউন অনুবাদ)
২রা শ্রাবণ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ
১৭ই জুলাই ২০১৮
২রা শ্রাবণ ১৪২৫ বঙ্গাব্দ ॥ ১৭ই জুলাই ২০১৮
আপনার লেখা প্রকাশ করতে চান?
আমরা সবসময়ই নতুন চিন্তাকে স্বাগত জানাই। আপনার লেখা প্রকাশের জন্য আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন।
লেখা জমা দিনপেমা চোদ্রোন তাঁর “বিশ্রী দুনিয়া” বইতে বৌদ্ধ শ্রমণ শান্তিদেবের এক গল্পের সঙ্গে জোরালো মিল তুলে ধরেন। এই ‘বিশ্রী দুনিয়া’র সারকথা আমার খুব পছন্দের। একটা ভিডিও থেকে এর অনুলিপি করেছি। হুঁশিয়ারি জানিয়ে রাখি। এখানে যা শুনব তা খুব চেনা এবং অস্বস্তিকর।
চোদ্রোন শুরু করেন:
এই বিশ্রী দুনিয়া, বিশ্রী মানুষ, বিশ্রী সরকার, বিশ্রী সবকিছু… বিশ্রী আবহাওয়া…বিশ্রী এটা সেটা। আমরা মহা বিরক্ত। এখানে বড়ো গরম। বড়ো শীত। এই গন্ধ আমার সহ্য হয় না। আমার সামনের লোকটা বড়ো বেশি ঢ্যাঙা, আমার পিছনের লোকটা বড়ো বেশি মোটা। ঐ লোকটার গায়ে যেন কী এক লেবাস, গন্ধটা আমাকে — আআআ !
যেন আমরা খালিপায়ে হাঁটছি আর পায়ের নিচে ফুটন্ত বালি, অথবা চূর্ণ কাঁচ, অথবা কাঁটা ভরা প্রান্তর। আমরা হাঁটছি আর যেন বলছি, ‘এ বড়ো কঠিন। খুব ব্যথা লাগছে। ভীষণ বাজে লাগছে। বড়ো বেশি তীক্ষ্ণ, বড়ো গরম, বড়ো ব্যথা।’ হঠাৎ আপনার একটা দারুণ বুদ্ধি আসে। আপনি যেখানে যাবেন সেখানে চামড়ায় মুড়িয়ে নেবেন। তখন পায়ে আর ব্যথা করবে না।
চারিদিকে চামড়া মুড়িয়ে রাখা মানে যেন আমাদের ক্ষেত্রে বলা, ‘আমি ওকে বের করে দেব। তাকে বের করে দেব। তাপমাত্রা ঠিক করে নেব। আমি ওই পারফিউম দুনিয়া থেকে লোপাট করে দেব। আমাকে যা বিরক্ত করে এমন কিছু থাকতে দেব না। আমি সব তাড়াব, মশাদের তাড়াব, আর তারপর আমি সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকব।’
[উনি থামেন]
আমরা হাসি, কিন্তু এমনটা আমরা সকলেই করছি। ঠিক এভাবেই আমরা সব সামধানের দিকে এগোই। আমরা ভাবি, আমরা যদি সব কিছু ঝামেলা তাড়াতে পারি, দুনিয়াটাকে আগাগোড়া চামড়া দিয়ে ঢেকে দিতে পারি, তাহলে আমাদের ব্যথাবেদনা চলে যাবে। হ্যাঁ নিশ্চয়ই — কারণ আমাদের পা আর দগদগে হবে না। খুব যুক্তিযুক্ত কথা, নয় কী? কিন্তু কথাটা আসলে অর্থহীন। শান্তিদেব বলেন, ‘আমরা যদি আমাদের পা দুটি শুধু ঢেকে রাখি, অর্থাৎ কিনা আমরা জুতোয় পা গলিয়ে তাতালো বালি, কাঁটাময় পথ আর কাচের টুকরোর ওপর হেঁটে আসতে পারি, আমাদের ব্যথা করবে না। সুতরাং উপমা টানা হচ্ছে এভাবে যে, আমরা যদি আমাদের মন নিয়ে কাজ করি, দুনিয়াকে না পাল্টে, তবে আমাদের মেজাজ শান্ত হবে।
সারা দুনিয়া চামড়ায় ঢেকে দেওয়া যদি অসম্ভব, তবে মানুষে মানুষে এই অচ্ছেদ্য বন্ধনের ওপর বিশ্বাসকে আমরা লালনপালন করব কেমন করে? আমার গবেষণায় এই প্রশ্নের যে জবাব পেলাম তা আমার রোম খাড়া করে দেয়।
“সম্মিলিত আনন্দবেদনায় সামিল হও, যেন এই অচ্ছেদ্য বন্ধনকে নিজে চাক্ষুষ করতে পারো।”
যে পুরুষ-নারী মধ্যে আপন হবার বোধ সবচেয়ে মজবুত, তারা মানুষের মধ্যে অচ্ছেদ্য বন্ধনের ওপর আস্থা রাখে এই ভাবে — আনন্দ বেদনায় অচেনা মানুষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। আরেকটু সহজ করে বলতে গেলে — সেই সব বিদ্যুৎ-কে বোতলবন্দী করে রাখতে হবে। মানুষের মধ্যে সংযোগের, আনন্দের, উৎসবের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা যথেষ্ট পরিমাণে জমাতে পারলে আমরা বিশ্বাস করতে পারব এমনটা যে কারুর পক্ষে সম্ভব।
মানুষের মানুষে সংযোগের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা আমার গবেষণায় আনকোরা নতুন জিনিস। অথচ এর মানে বুঝতে গিয়ে, এর গভীরে খুঁড়তে গিয়ে আমি যেমন মজা পেয়েছি তেমন আর কখনো হয়নি। এই ব্যাপার নৈমিত্তিক কেমন করে চর্চা করতে হয় বুঝতে গিয়ে দেখলাম আমি বেশ অনেক দিন ধরেই এই কাজ পোক্ত ভাবে ক’রে চলেছি। এর আগে কখনো বুঝতে পারিনি সম্মিলিত মুহূর্তকে আমি এতো কদর কেন করি। আমি বুঝতে পারিনি, যাদের সঙ্গে আমার বিশ্বাসের মিল নেই, যাদের সুযোগ পেলেই এক হাত দেখে নিতে ইচ্ছে করে, অথবা হাতে একটা কিল বসিয়ে দিতে পারি, কেন তাদের সঙ্গে আমি গির্জায় মিলিত হয়ে একসঙ্গে রুটি ভেঙে খাই, গলা মিলিয়ে গান করি। কেন আমি আমার সন্তানদের নিয়ে গানের উৎসবে যাই, তাদের হাত ধরে আবেগে ভাসি। কেন আমার পাশ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত সংগীত শুনলে আমার মনটা এমন তাথৈ নেচে ওঠে। কেন আমি আমার সন্তানদের শেখাই কেউ মরে গেলে শ্রাদ্ধ, কুলখানি বা শেষকৃত্যে যাওয়া এত জরুরি। কেন হাজির থাকা জরুরি। অংশ নেওয়া জরুরি। প্রত্যেক সংগীতে। সব আরাধনায় — এমন কি ভিন ভাষা, ধর্ম, বা সংস্কৃতির অনুষ্ঠান হলেও কিছু এসে যায় না।।
(চলবে…)