
দ্বন্দ্ব সমাস
২৭শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১০ই জুন ২০২৫
২৭শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ॥ ১০ই জুন ২০২৫
৫৮৯ শব্দ · ⏱ পড়তে আনুমানিক ৩ মিনিট লাগবে
মাথার উপরে ঝাঁ ঝাঁ রোদ । বাসস্থানের সামনে ময়লার বিনে চোখ পড়ে রুপার। কে যেন বেবি ডায়পার ফেলে রেখেছে। সেটা দেখেই উৎকট বমি আসতে থাকে। সট করে হাতঘড়িটা দেখে নেয় । বাস আসতে এত লেট করছে কেন কে জানে । জ্যাম ঠেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত গড়িয়ে আসবে মনে হচ্ছে। ইদানীং রাস্তার অবস্থা তেমন ভালো নয়। দেরী করে বাসায় ফিরলে মা চিন্তায় অস্থির হয়ে যান । ফোনে তেমন চার্জও নেই। পত্রিকায় পড়া সেইদিনের খবরটা চোখে ভেসে উঠল । “কর্মজীবী নারীকে রাতের বাসে ধর্ষণ”…
সেকথা-কুকথা ভাবতে ভাবতে বাস চলে এলো । যাক বাবা, একটা সিট খালি আছে তাহলে । ওড়নায় ঘাম মুছতে মুছতে ওপাশের সিটের বাচ্চার দিকে চোখ গেল । মায়ের কোলে বসে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে রুপার দিকে । বেশ নাদুস-নুদুস নধর বাচ্চা। বাচ্চার মায়ের দিকে স্মিত হাসি দিয়ে রুপা খেয়াল করে বেশ কঙ্কালসার মহিলা । একহাতে ফোন, অন্য হাতে ভারী বাচ্চার শরীর । বয়স আর কতই হবে মেয়েটার? ২২? ২৪? দুশ্চিন্তাগ্রস্ত গলায় কথা বলতে থাকে, “ আইচ্চা, সামনের মাসের বেতন কি পামু? এইদিকে ঈদ যে আইসা পড়ল । ঘর ভাড়া দিমু কি আর খামুই বা কি?”
মেয়েটি ফোন রাখতেই রুপা জিজ্ঞেস করে, “বয়স কত ছেলের?”
“ পোলা না আপা, মাইয়া, পোলাগো জামা পরাই রাখছি, আমার বইনের পোলার জামা” , মেয়েটি বলল।
রুপা স্মিত হাসল । বাস হালকা ঝাঁকি খায়, বাচ্চাটা দুলে ওঠে কাঁদতে থাকে ।
“না না না কান্দে না, এইতো আইসা পড়ছি” ।
বাচ্চা কিছুতেই কান্না থামায় না । গরমে অতিষ্ট হয়ে মা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে “ ওর বাপ নাই, বিয়া করছে আরেক জায়গায়। থাকি মেস বাসায়, আমার লগে কাম করে আরেক মাইয়া, হের লগে খরচ সামলাইতে হিমশিম খাই , গতর খাটাইয়া কাম করি, কিন্তু বাচ্চার মুখের দিকে তাকাইয়া সব সহ্য করন লাগে ।”
রুপা চুপচাপ শোনে। মেয়েটার জন্য তার মনে সহানুভূতি জাগে। কিন্তু এত অল্প বয়সে বাচ্চাই বা নিতে বলল কে? সাতপাঁচ না ভেবে জিজ্ঞেস করেই বসে, “ মা কি নিজের ইচ্ছাতেই হইছেন, নাকি হয়ে গেছে?”
মহিলার গাল লাল হয়ে যায়। “ কি যে কন আপা, আল্লায় দিসে, বাচ্চা তো আল্লার রহমত। আমার মাইয়া আমার কলিজার টুকরা”
উত্তর শুনে রুপা নড়ে চড়ে বসে । মুহূর্তে মহিলাকে দেখে তার হিংসা হয় । কোলের স্বর্গীয় শিশুর সাথে মায়ের চেহারা মোটেই মানানসই নয়। কিন্তু তাদের মধুর খুনসুটি দেখে হিংসায় জ্বলে পুড়ে যায় রুপা।
পরক্ষনেই ভাবতে বসে, আচ্ছা, তার কি মা হতে ভালো লাগবে? এই যে এত বেদনা, কষ্ট, গ্লানি, এই সবকিছুর উপরেই কি মাতৃত্ব মহান? হয়তো না। হয়তো মেয়েটি যা দেখাচ্ছে , আসলে তা তার লোক দেখানো অনুভূতি। ও কি বোঝে সমাজ তার উপরে কিভাবে মাতৃত্ব চাপিয়ে দিয়েছে?
রুপার হাত – পা ঘামতে থাকে। দুশ্চিন্তায় হাতের নখ খুটতে থাকে সে। একবার ভাবে, মা না হলে কীইবা যায় আসে, জীবন কি এতই ছোট? কত কত জায়গায় ঘোরার আছে, পৃথিবীর কত কিছুই দেখার আছে, জীবন টা একটা চক্রে বেধে থাকুক তাও সে চায় না।
কিন্তু সন্তান হলে তো এইসব সম্ভব না। ময়লার বিনের বেবি ডায়পারটা আবার চোখের সামনে আসে। এমন কত শত ডায়পার বদলাতে হবে রাতের পর রাত, ঘুম নিদ্রা সব হারাম হয়ে যাবে। Is a child worthy of all this sacrifice? এরপরে রুপার মেয়েটির প্রতি করুণা হয়। গরীব ঘরের মেয়ে, কতটুকুই বা শখ আহ্লাদ আছে? কুয়োর ব্যাঙ্গের কাছে তো কুয়োটাই পৃথিবী।
“দুইন্যার সব ধন -সম্পদ পায়ের কাছে আইনা দিলেও, আমার মাইয়া আমার কাছে হীরার টুকরা,বুঝলেন আপা?” সম্বিৎ ফিরে পায় রুপা। মেয়েটা কি তার মনের কথা সব শুনে ফেলেছে?
“আইচ্ছা আপা যাই, আমার মাইয়ার জন্য দোয়া রাইখেন” বলে বাস থেকে নেমে পড়ে।
রুপা অসাড়ের মত বসে থাকে, মাতৃত্ব নাকি স্বাধীনতা? কোনটা চাই তার? বাস চলতে থাকে পরের গন্তব্যে …।